‘এক দিনের কসাই’

ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

বছরের অন্যান্য দিন রিকশাচালক, দিনমজুর, ফুটপাতের বিক্রেতা হিসেবে কাজ করলেও কোরবানি ঈদ এলেই তৎপর হয়ে ওঠে তারা। মহল্লার মানুষের কাছে তারা ‘এক দিনের কসাই’ হিসেবে পরিচিত। ছুরি, দা, চাপাতি- মাংস কাটার যন্ত্র থাকে তাদের সংগ্রহে। পেশাদার মাংস শ্রমিকের মতো কাজ না করতে পারলেও পাড়ায়-মহল্লায় তাদের চাহিদা বাড়ে কোরবানির ঈদে।

আজ বুধবার ঈদের জামাতের পরপরই ঢাকার পূর্ব কাজিপাড়ায় ‘কসাই লাগবে কসাই’ বলে ফেরি করছিলেন ছয় জন। তাদের সঙ্গে আছেন এলাকার চা দোকানদার হানিফ। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদে কসাইয়ের কাজ করে কিছু বাড়তি উপার্জন করা যায়। গত ১০ বছর ধরে কোরবানির ঈদে আমি এই এলাকায় কাজ করি। আমার কাছে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিও আছে।’

ছয় জনের এই দলটির কাজ পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। হানিফ বলেন, ‘সকালে ডিমান্ড থাকে অনেক। আমরা তিনটা অর্ডার নিতে চাই। একটা আবাসিক ভবনে নয়টা গরু আছে। আমরা দুটো গরু কাটার অর্ডার পেয়েছি।’

পেশাদার মাংস শ্রমিকদের চেয়ে কাজ শেষ করতে তাদের সময় লাগে অনেক বেশি। হানিফ বলেন, ‘দুটো গরুর কাজ শেষ করতেই অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা আরও একটা অর্ডার পাওয়ার চেষ্টা করব। যেহেতু বিকেল হয়ে যাবে তাই শেষেরটার জন্য আরও কম দামে রাজি হতে হবে। আমরা ছাগলও জবাই করি।’

দুটি গরুর জন্য ১৮ হাজার টাকায় চুক্তি করেছেন হানিফ। এই টাকাটাই ছয় জনে ভাগ করে নেবেন। পাশাপাশি কিছু মাংসও পাবেন।

এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেশাদার মাংস শ্রমিকরা গরুর দামের ২০ শতাংশ রেটে কাজ করেন। তারা লাখ টাকার বড় গরু ছাড়া চুক্তিবদ্ধ হন না।

মিরপুরের পীরেরবাগে মাংস দোকানের মালিক চান সুরুয ওরফে ‘চান্দু কসাই’। পূর্ব শ্যাওড়াপাড়ার একটি ভবনে মাংসশ্রমিকের কাজ করেছিলেন তিনি। সঙ্গে আছে তার ১০ বছরের ছেলে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি তিন দিন আগে এই বিল্ডিংয়ের দুটো গরুর কাজ পেয়েছি। ঈদের নামাজ শেষে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই চলে এসেছি। দুটো গরুর কাজ শেষ করতে ১২টা বাজবে। সাহায্য করার জন্য দুজন দিনমজুরকে নিয়ে এসেছি। আমার ছেলেটাও আছে।’

দেড় লাখ টাকার দুটি গরুর ২০ শতাংশ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে অপেশাদার, এক দিনের মাংস শ্রমিকেরা কাজ করছেন গরুর দামের আট কিংবা ১০ শতাংশ রেটে। যাদের ছোট গরু তারা এই অপেশাদার মাংস শ্রমিকদের সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ হন। কোরবানির ঈদে মাংস কাটার কাজ পেতে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে আসেন।

উত্তর কাফরুলে মাংস কাটার কাজ পেতে ফেরি করছিলেন শফিক, সেলিম, মানিক, রিয়াজ ও মাহফুজ। মাংস কাটার কাজ করতে বগুড়া শাহাজাহানপুর থেকেই ঢাকায় এসেছেন শফিক ও সেলিম। তারা জানান, গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। রিকশা চালিয়ে খুব কম উপার্জন হয়। ঢাকা শহরে মাংস শ্রমিকের চাহিদা আছে। তাই ঈদে কাজ করতে ঢাকায় এসেছেন।

তারা বলেন, ‘১০-১২ বছর ধরে আমরা কোরবানির দিনে কসাইয়ের কাজ করি। গ্রামের হাটে গরু জবাই দিলেও আমাদেরকে ডাকে। কোরবানি ঈদে কাজ করার রিস্ক আছে। অনেক সময় মাংস কাটতে ভুল হয়, না হয় দেরি হয়ে যায়। এগুলো মাথায় রেখেই সাবধানে কাজ করতে হয়।’

কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পেশাদার মাংস শ্রমিকের চাহিদা বেশি। ওদের কাছে গেলে বেশি টাকা লাগে। তাই ‘এক দিনের কসাই’ দিয়েই কাজ করান তারা। ওদের দিয়ে কাজ করালে সময় লাগে বেশি। নিজেদেরও সহযোগিতা করতে হয়।

পূর্ব কাজিপাড়ার বাসিন্দা নাঈম ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি ঈদের আগে গত কয়েকদিন ধরে কসাই খুঁজেছি। আমার গরু ছোট। পেশাদার মাংস শ্রমিকেরা দেড় লাখ টাকার নিচের গরুতে হাত দিতে চান না। দুপুর ১২টা বাজেও আমি পেশাদার মাংস শ্রমিক পাইনি। বাধ্য হয়েই অপেশাদার মাংস শ্রমিকদের ডাকতে হলো। তারা বলেছেন, মোটামুটি এসব কাজ পারেন। তাদেরকে সাড়ে চার হাজার টাকা দেব। কিছু মাংসও দেব। এটায় ঝুঁকি আছে। মাংস কাটা শেষ করতে বিকেল হয়ে যাবে। কিন্তু কী করবো বলুন, পেশাদার কসাই তো সাত দিন আগেই বুকড!’

অপেশাদার মাংস শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর আরেকটি ঝুঁকি হলো তারা অনেকেই কোরবানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানেন না।

কাজিপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, ‘অদক্ষ মাংস শ্রমিকরা অনেক সময় ভুড়ি, চামড়া এগুলো ঠিকঠাক কাটতে পারেন না। মাংস নষ্টও করেন। কোরবানির পশুর বর্জ্য কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় এটা না জানলে রাস্তাঘাট ময়লা করে ফেলতে পারে।’ 

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে পাঁচ-সাত লাখেরও বেশি গরু কোরবানি দেওয়া হয়। ২০ হাজারের মতো পেশাদার মাংস শ্রমিক বর্তমানে ঢাকায় আছেন। আগে আরও ছিলেন, তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন।’

Comments

The Daily Star  | English

You have crushed fascism, now strengthen democracy and press freedom

The Daily Star Editor Mahfuz Anam's appeal to the ‘new generation leaders’

11h ago