ঋণের চক্রে ফেলে যেভাবে রানী বেগমের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছিল মহাজন
দুই বছর আগে স্ত্রীকে না জানিয়ে সপ্তাহে ১ হাজার টাকা সুদে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন স্বামী। কিন্তু সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি সুদে টাকার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে গেলে স্বামী পালিয়ে যান। ঋণ পরিশোধের জন্য স্ত্রীকে জিম্মি করেন সুদের কারবারি মহাজন। স্ত্রীকে দিয়ে গৃহস্থালি কাজ করানোর পাশাপাশি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা আদায় করেন। এক পর্যায়ে ওই নারীকে না জানিয়ে তার নবজাতক সন্তানকেও বিক্রি করে দেন মহাজন।
ভুক্তভোগী নারী রানী বেগম (২৮) সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সদরে আদালত প্রাঙ্গণে দ্য ডেইলি স্টারকে এ সব কথা জানান। তিনি উপজেলার আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি স্টাফ কোয়ার্টারে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন।
এখনো মহাজন লাকি আক্তার তার কাছে ১ লাখ ৩ হাজার টাকা পান বলে দাবি করছেন, ভুক্তভোগী রানী জানান।
এ ঘটনায় রানী বেগম গতকাল রোববার সুদ কারবারি মহাজন লাকী আক্তার ও তার স্বামী হযরত আলীসহ ৩-৪ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেছেন।
রোববার রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণ পাশা গ্রাম থেকে ১ বছর আগে বিক্রি করা নবজাতককে উদ্ধার করে। এ সময় নবজাতক কিনে নেওয়া রানু বেগমকে (৪০) আটক করা হয়।
সোমবার সকালে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে লাকী আক্তারকে (২৬) পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
দুপুরে লাকি আক্তার ও রানু বেগমকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত লাকি আক্তারকে ১ দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন। রানু বেগম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে, তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজমুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
রানী বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। কাজের সন্ধানে স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে আসেন।
তিনি বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে লাকির বাবার কোয়ার্টারের বাসায় এক রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করি। লাকির কাছ থেকে আমার স্বামী ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় স্বামীকে মারধর করে লাকি ও তার স্বামী হযরত। পরে আমার স্বামী পালিয়ে যায়। ঋণের টাকার জন্য তারা আমাকে জিম্মি করে। আমাকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ইট ভাঙার কাজ করায়।'
'সেখান থেকে ৩০০-৫০০ টাকা মজুরি আসতো। সেটা লাকি নিয়ে যেত। তাদের ঘরের সব কাজ আমাকে দিয়ে করাতো। এভাবে আমি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা শোধ করেছি,' বলেন রানী।
তিনি বলেন, '২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে লাকি আক্তারের বাসায় আমি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেই। আমি অসুস্থ থাকায় লাকি ও তার স্বামী হযরত আলী আমাকে বলেন যে অসুস্থ শরীর নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে আমি কাজ করতে পারব না। এ কথা বলে তারা আমার ছেলেটাকে বিক্রি করে দেয়।'
'পরে তারা আমাকে জানায় যে ২৫ হাজার টাকায় আমার ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে। আর ওই টাকাও রেখে দেয় তারা। পরে গত ১৪ এপ্রিল তারা সুদসহ আরও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে নির্যাতন করে,' যোগ করেন তিনি।
রানী বেগম বলেন, 'তারা সরকারি চাকরি করে, পুলিশ তাদের কথা শোনে। তাই ভয়ে এতদিন কিছু বলিনি। বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে তারা আমাকে মারধর করতো। বাচ্চাটা দেখতে চেয়েছি, ১ বছরে তারা বাচ্চাকে দেখতে দেয়নি। কয়েকদিন আগে কলোনিতে টাকার জন্য একজনকে মারধর করার পর লাকির স্বামী হযরত পালিয়ে যান। তখন আমি পুলিশে অভিযোগ দেওয়ার সাহস পাই।'
সোমবার দুপুরে সরেজমিনে আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি স্টাফ কোয়ার্টারে গিয়ে লাকি আক্তারের কথা জানতে চাইলে সেখানকার বাসিন্দা রুবিয়া বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছেলে ইমামুল শতকরা ২০ টাকা সুদে লাকির কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়। ১ লাখ টাকা পরিশোধ করছে। কিন্তু এখনও ৫০ হাজার টাকা দাবি করে লাকি। টাকা দিতে পারব না বললে, আমার ছেলেকে মারধর করে স্ট্যাম্পে সই নেয় লাকি ও হযরত আলী। সবার সঙ্গেই তারা এমন করে। কিন্তু কেউ ভয়ে কথা বলে না।'
৪ মাস আগে লাকির বাবা আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন স্থানীয় চা দোকানদার মো. বাবুল।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, '১ সপ্তাহের জন্য ৪ হাজার টাকা নিয়েছিলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে শোধ করতে পারিনি। পরে ২ হাজার টাকা ফেরত দিতে গেলে তিনি বলেন যে আমাকে সুদে টাকা দিয়েছিলেন।'
'এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার টাকা সুদ দিয়েছি। তাও বলে ৩ হাজার টাকা পাবে। এক সপ্তাহ আগে আমি বলে দেই আর টাকা দিতে পারব না। পরদিন হযরত আলী কয়েকজনকে নিয়ে এসে আমার বাসায় ঢুকে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে মারধর করে। এ ঘটনায় আমি থানায় অভিযোগ দিয়েছি। ওইসময় সুদের টাকার জন্য রানীর ছেলে বিক্রির কথা জানাজানি হয়,' বলেন মো. বাবুল।
স্থানীয়রা জানান, অসহায় গরীব ও অশিক্ষিতদের ১ হাজার টাকায় সপ্তাহে ২০০ টাকা সুদে ঋণ দেন লাকি আক্তার। ঋণ দেওয়ার সময় সাদা কাগজে টিপ সই কিংবা সই রাখেন তিনি। পরে সময়মতো ঋণের টাকা শোধ দিতে না পারলে মূল টাকার সুদের ওপর সুদ ধরে টাকা দাবি করেন লাকি। তাদের সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে কয়েকটি পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে।
তারা বলেন, 'লাকির বাবা আজাদ ও স্বামী হযরত আলী সরকারি অফিসে চাকরি করেন। সেজন্য মানুষ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগ করেন না। আবার অনেকে বিপদে তাদের কাছেই টাকা পায়, সেজন্য কিছু বলতে চায় না।
লাকির বাবা আবুল কালাম আজাদ ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি সোহরাওয়ার্দী স্মৃতি মিলনায়তনে পাহারাদারের কাজ করেন। মেয়ের জামাই হযরত আলী প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
তিনি বলেন, 'আমি সুদে কাউকে টাকা দেইনি। বাবুল যেটা বলছে এটা মিথ্যা কথা। তবে আমার মেয়ে সুদে টাকা দেয় এটা আমি জানি। এজন্য আমি তাকে অনেকবার নিষেধও করেছি। কিন্তু সে শোনেনি। তবে কাকে কীভাবে লাকি টাকা দেয়, আমি জানি না। রানীর স্বামীকে সুদে টাকা দিয়েছে এটা আমি জানি। এখন কত টাকা পায় আমি জানি না।'
সুদের টাকার জন্য বাচ্চা বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সে সময় আমি বাসায় ছিলাম না। আমি কিছু জানি না। পুলিশ লাকিকে ধরে নিয়ে গেছে। লাকির স্বামী পলাতক।'
এএসপি নাজমুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিশু বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে। এ সময় রানু বেগম নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।'
তিনি বলেন, 'প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রানু পুলিশকে জানিয়েছেন যে তিনি ৬৫ হাজার টাকার বিনিময়ে লাকি বেগমের কাছ থেকে শিশুটিকে কিনেছেন। তবে কেনার সময় শিশুর মা উপস্থিত ছিলেন না।'
'আজ সকালে লাকি বেগমকে গ্রেপ্তার করা হলেও, তার স্বামী হযরত আলী পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আর রানু বেগমকে একই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তিনি অপরাধ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। লাকী বেগমকে ১ দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত,' যোগ করেন তিনি।
Comments