ঈদে নারায়ণগঞ্জের যেসব দর্শনীয় স্থানে যেতে পারেন
আগামীকাল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীদের জন্য নারায়ণগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গত দুই বছর করোনা মহামারিতে এসব দর্শনীয় স্থানগুলো বন্ধ থাকায় লোকসান হয়েছে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাই এবার দর্শনার্থীদের সমাগম বেশি হবে এমনটাই আশা করছেন তারা।
প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যের স্বনামধন্য নারায়ণগঞ্জে দর্শনার্থীদের জন্য আছে সোনারগাঁও উপজেলায় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁও জাদুঘর হিসেবে পরিচিত), হারানো নগরী হিসাবে সুপরিচিত পানাম নগর বা পানাম সিটি, ভারতের আগ্রার তাজমহলের আদলে বাংলার তাজমহল বা দ্বিতীয় তাজমহল, মিশরের পিরামিডের প্রতিরূপ, বারদী লোকনাথ আশ্রম, রূপগঞ্জ উপজেলায় জিন্দা পার্ক, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি, শহরে হাজীগঞ্জ দুর্গ, বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জে কদম রসূল দরগাহ, সোনাকান্দা দুর্গ, ফুলের গ্রাম সাবদী ইত্যাদি।
রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে সোনারগাঁও উপজেলার বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ও পানাম নগর গিয়ে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রেখে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। যারা যাচ্ছেন সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ বলছেন, আগামী মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা হবে ফাউন্ডেশন ও পানাম নগরীর ফটক।
সোনারগাঁও জাদুঘর
সোনারগাঁও জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকশিল্পকে ধরে রাখার উদ্দেশে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরীর একটি পুরোনো বাড়িতে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আছে সরদার বাড়ি, জয়নুল আবেদিনের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আবক্ষ ভাস্কর্য, জয়নুল আবেদীনের ভাস্কর্য, জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর, লোকজ মঞ্চ, সেমিনার রুম, কারুশিল্প গ্রাম এবং সবুজে মোড়া সুবিশাল উদ্যান। এছাড়াও জাদুঘরের বিভিন্ন গ্যালারিগুলোতে দেখা যাবে কাঠে খোদাই করা বিভিন্ন কারুশিল্প, পটচিত্র, মুখোশ, আদিম জীবনভিত্তিক নিদর্শন, লোকজ বাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির ফলক, লোহা, তামা-কাসা-পিতলের জিনিসপত্র, লোকজ অলংকারসহ প্রাচীন নিদর্শন।
পানাম নগর
১৫ শতকে ঈশা খাঁ সোনারগাঁয়ে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। সোনারগাঁয়ের প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছিল এই নগরী। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় পানাম নগর স্থান পায়। পানাম নগরী চারদিকে পঙ্খীরাজ খাল দিয়ে ঘেরা। পানাম নগরীর বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে আছে ভিন্নতার ছাপ। নগরীর প্রতিটি দালানে আছে অপূর্ব কারুকার্য ও আভিজাত্য ছোঁয়া। এখানে আছে ৫২টি ভবন। এই ভবনগুলো কোনটি এক তলা, কোনটি আবার দুই বা তিন তলা বিশিষ্ট।
রাজধানী ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার অভ্যন্তরে এই দুটি দর্শনীয় স্থানের অবস্থান। ঢাকা থেকে মাত্র ১ ঘণ্টার দূরত্ব।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক রবিউল ইসলাম গতকাল রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মে দিবস উপলক্ষে জাদুঘর বন্ধ আছে। ঈদের দিন দুপুর ১২টা থেকে খুলবে। আর ঈদের পরদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।'
তিনি বলেন, 'করোনা মহামারিতে জাদুঘর বন্ধ ছিল। দর্শনার্থীরা আসতে পারেননি। তবে এবার প্রতিদিন ৪-৫ হাজার দর্শনার্থী হবে এমনটাই আশা করছি। এজন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।'
পানাম নগরীর ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদের দিন থেকে খোলা থাকবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন। টিকেটের মূল্য আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।'
বাংলার তাজমহল
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম ভারতের আগ্রার তাজমহল। সেই তাজমহলের মতো করে সোনারগাঁ উপজেলার পেরাব গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলার তাজমহল বা দ্বিতীয় তাজমহল। শিল্পপতি ও চলচ্চিত্রকার আহসান উল্লাহ মনি এটি নির্মাণ করেছেন। তাজমহলের প্রধান ভবন দামী স্বচ্ছ পাথরে মোড়ানো। তাজমহলের ভেতরে আহসান উল্লাহ মনি এবং তার স্ত্রী রাজিয়ার কবরের স্থান সংরক্ষণ করা আছে। আগ্রার তাজমহলের মতোই মূল ভবনের ৪ কোণে ৪টি বড় মিনার আছে। আর ভবনের সামনে আছে পানির ফোয়ারা, ফুলের বাগান এবং দর্শনার্থীদের বসার স্থান।
মিশরের পিরামিডের প্রতিরূপ
তাজমহলের কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে মিশরের পিরামিডের প্রতিরূপ। এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য, ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি ভাস্কর্য, ২৫০ আসন বিশিষ্ট সিনেমা হল এবং সেমিনার কক্ষ। এছাড়াও পিরামিডের ভিতরে আছে মমির প্রতিরূপ, রাজারাণীদের অলংকার, পোশাক, আসবাবপত্রের প্রতিরূপ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে কুমিল্লা বা সোনারগাঁগামী বাসে চড়ে মদনপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে, সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশায় তাজমহল দেখতে যাওয়া যায়। অন্যদিকে রাজধানীর কুড়িলের ৩০০ ফিট রাস্তা দিয়ে ভুলতা গিয়ে, সেখান থেকে অটোরিকশা বা সিএনজিতে তাজমহল যাওয়া যায়।
এছাড়াও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে নরসিংদী বা ভৈরবগামী বাসে বরপা বাসস্ট্যান্ডে নেমে সিএনজিতে তাজমহল যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বাংলার তাজমহলের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।
বাংলার তাজমহলের ইনচার্জ দেওয়ান মোহাম্মদ এলাহী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখানে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন। তারা যেন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে দর্শন করতে পারেন এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে। সবুজ ও ফুলের সমাহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্ট, পাখির মেলা ইত্যাদি জায়গায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।'
১৫০ টাকা টিকেটে তাজমহল ও পিরামিড দর্শন করা যাবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'করোনায় গত ২ বছর ঈদে আমরা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখিনি। তখন অনেক লোকসান হয়েছে। আশা করছি এবার প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি দর্শক হবে। এই ঈদের লোকসান কাটিয়ে ওঠা যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'শিল্পপতি চলচ্চিত্রকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মনি এই তাজমহল তৈরি করেছেন। তিনি শখে এটি নির্মাণ করেছিলেন। ৭ বার আগ্রার তাজমহলে যাওয়ার পর তিনি মনে করেছেন যে আগ্রা গিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে সেটি উপভোগ করা সম্ভব না। তাই স্বল্প পরিসরে এখানে তিনি এটা নির্মাণ করেছেন যেন কম খরচে সবাই তাজমহল উপভোগ করতে পারে।'
তিনি জানান, এখানে আরও ২ বছরের কাজ বাকি আছে। তাজমহলের ভেতরে দামী পাথরের কাজ চলছে।
হাজীগঞ্জ দুর্গ
নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত হাজীগঞ্জ দুর্গ। মুঘল আমলে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক জল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
১৭ শতকের দিকে মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পর মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে নির্মিত ৩টি জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্টগুলোর মধ্যে হাজীগঞ্জ অন্যতম।
আর অপর ২টি দুর্গ হলো-সোনাকান্দা দুর্গ ও ইদ্রাকপুর দুর্গ।
১৯৫০ সালে এই হাজীগঞ্জ কেল্লাটিকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তালিকাভুক্ত করে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে হাজীগঞ্জ দুর্গের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখানে আছে পঞ্চভুজ সীমানা প্রাচীরের দেয়ালে বন্দুক রেখে গুলি ছোঁড়ার স্থান। দুর্গের ৪ কোণে আছে ৪টি বুরুজ। এছাড়াও প্রাচীরের উপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি এবং এক কোণে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে কামান রাখার বেদি আছে।
এখানে প্রবেশ করতে কোনো টিকেটের প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিনই এর গেট উন্মুক্ত থাকে।
জিন্দা পার্ক
রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নে ১৫০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত জিন্দা পার্ক। জিন্দা পার্কে আছে ২৫০ প্রজাতির ১০ হাজারের বেশি গাছ, ৫টি জলাধার ও অসংখ্য পাখি। চারপাশে সবুজের আচ্ছাদন। গাছের উপরে আছে টং ঘর, বড় শান বাধানো পুকুর, পুকুরের উপর সাঁকো, মাটির ঘর, মার্কেট, লাইব্রেরি, ক্যান্টিন ইত্যাদি।
ঢাকা থেকে জিন্দা পার্কের দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। যাওয়ার রাস্তা কুড়িল বিশ্বরোড পূর্বাচল হাইওয়ে (৩০০ ফিট রাস্তা) দিয়ে জিন্দা পার্ক। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে এটি খোলা থাকে।
জিন্দা পার্কের পরিচালক মো. কাজল আকন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদকে কেন্দ্র করে তেমন নতুন কোনো কিছু নেই। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়েছে। নিরাপত্তায় পুলিশ ও আমরা নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক টিম কাজ করবে।
তিনি জানান, টিকেটের দাম ছুটির দিনে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৫০ টাকা ও শিশুদের জন্য ৫০ টাকা।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদ উপলক্ষে আমাদের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে টুরিস্ট পুলিশও কাজ করবে। জেলা পুলিশ ও টুরিস্ট পুলিশ মিলে একটি নিরাপত্তা বলয় আছে।'
'সুন্দর করে সবাই যেন ঈদ করতে পারে, ঈদ পরবর্তী সময় কাটাতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
Comments