‘আমরা ফিরে ভাত খাব’, শহীদ ছেলের জন্য রোজ রান্না করেন কুলসুম

ছেলে শহীদ ওমর ফারুকের জন্য ৫০ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন মা কুলসুম বেগম। ছবি: টিটু দাস

পিরোজপুরে নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের সংলগ্ন পুরনো টিনের ঘরে মা কুলসুম বেগম তার শহীদ ছেলের জন্য ৫০ বছর ধরে অপেক্ষা করছেন।

ছেলে এসে যেন ফিরে না যায় সে জন্য ঘরের প্রধান দরজা খুলে রাখেন তিনি এবং দরজার সামনেই একটি ঘরে থাকেন।

ছেলের জন্য ভাত রান্না করা হয় প্রতিদিন।

দীর্ঘ ৩ বছর ধরে অসুস্থ এই মা স্বাভাবিক জ্ঞান হারালেও পরিবারের পক্ষ থেকে একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে।

শহীদ ওমরের ছোট বোন সালমা রহমান হ্যাপী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় ২১ বছর বয়সী ওমর ফারুক মা কুলসুম বেগমকে বলে গিয়েছিলেন সে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে ফিরে এসে ভাত খাবে। বেশি করে ভাত রান্না করতে বলেছিলেন তিনি। সেই থেকে মা তার জন্য আজও অপেক্ষায় আছেন। দরজা বন্ধ করতে দেন না।'

ওমর ফারুকের বাড়ি। ছবি: টিটু দাস

'কোনো দিন মা বেড়াতে গেলে আমরা দরজা বন্ধ করেছি শুনলে রাগ করতেন। তার ধারণা, দরজা বন্ধ দেখে যদি ওমর ফিরে যায়! আমার মায়ের বয়স ৯৭ বছর। এক পা ভেঙে গেছে। গত ২ বছর ধরে তার স্বাভাবিক জ্ঞানও নেই। তারপরও অনেক সময় ওমরের নাম হঠাৎ মুখ থেকে বের হয়।'

'মায়ের যতদিন জ্ঞান ছিল ততদিন তিনি প্রধান দরজা বন্ধ করতেন না। আজও তাই ওমরের জন্য দরজা খোলা রাখা হয়।'

হ্যাপী আরও বলেন, 'আমাদের ৮ ভাইবোনের মধ্যে ওমর দ্বিতীয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রচারের জন্য পিরোজপুরে আসলে আমার বড়ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ছাত্রলীগে যোগ দেন। পরের বছর তিনি পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।'

'১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিনি শহীদ মিনার মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এই কারণে তার বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার মামলা করে। ২৫ মার্চ থেকে ওমর ফারুক মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করতে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ২৪ এপ্রিল তিনি মালখানা থেকে অস্ত্র লুঠ করায় নেতৃত্ব দেন।'

মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মনির ডেইলি স্টারকে জানান, পিরোজপুরে ৩ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসে। এসেই হুলার হাট, মাছিমপুর আর কৃষ্ণনগর গ্রামে গণহত্যা চালায়। ওমর ফারুকের নামে হুলিয়া জারি হয়।

তিনি বলেন, 'ওমর ফারুক সেসময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ২৯ জুন বরিশাল থেকে কুরিয়ানা যাওয়ার পথে লঞ্চঘাটে হানিফ নামে এক রাজাকার তাকে চিহ্নিত করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়। ৩০ জুন বরিশালের ওয়াপদায় বধ্যভূমিতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।'

হ্যাপী বলেন, 'ওয়াপদা টর্চার সেল থেকে ছাড়া পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক আমার চাচাত ভাই মানিককে জানান ওমরের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। তার পকেটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পেয়েছিল। ওই পতাকা লোহার দণ্ডে বেঁধে তারা "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" বলতে বললে ওমর "জয় বাংলা' বলে। পরে, সেই লোহার দণ্ড তার মাথায় ঢুকিয়ে দেয় ও বেয়নেট দিয়ে তাকে হত্যা করে।'

'হত্যার পর ৩ দিন মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল,' যোগ করেন তিনি।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিরোজপুরের জনসভায় ওমর ফারুকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করে নিজের গায়ে থেকে কোট খুলে শহীদ ওমর ফারুকের বাবার গায়ে পরিয়ে দেন বলে জানান তিনি।

ওমর ফারুকের নামে একটি ছাত্রাবাস, একটি কিন্ডারগার্টেন ও একটি পাঠাগার ছাড়াও একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে পিরোজপুর স্টেডিয়ামটি শহীদ ওমর ফারুকের নামে নামকরণের দাবি জানানো হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch political party by next February

Anti-Discrimination Student Movement and Jatiya Nagorik Committee will jointly lead the process

11h ago