অরক্ষিত খাল, বিপন্ন জীবন
খোলা নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে প্রাণঘাতী সব দুর্ঘটনার স্মৃতি বন্দর নগরীর বাসিন্দাদের মনে এখনো টাটকা। তবে এই পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনো নগরের অনেক খাল ও নালা তেমনই উন্মুক্ত পড়ে আছে, যা আরও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে।
পাশাপাশি বর্ষা মৌসুম এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকি ও আতঙ্ক আরও বাড়ছে।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই প্রতিবেদক চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি খাল ও নর্দমা অরক্ষিত ও প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিপূর্ণ অবস্থায় দেখতে পান।
এ সময় জামাল খান, চট্টেশ্বরী রোড, চাকতাই খাল, চকবাজার ফুলতলা, ষোলশহরের চশমা খাল ও কালুরঘাটের ওসমানিয়া খালসহ অনেক খালের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে সুরক্ষা দেয়াল চোখে পড়েনি।
এটি সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নয়। বছরের পর বছর ধরে এসব অরক্ষিত খাল ও নালায় পড়ে নিয়মিত নানা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই বাকলিয়ায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হাটহাজারীর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া পা পিছলে ড্রেনে পড়ে যান। পরের বছর ২০১৮ সালের ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় আল আমিন নামের এক শিশু ড্রেনে পড়ে যায়।
গত বছরের ৩০ জুন ষোলশহরের চশমা হিল এলাকায় একটি অটোরিকশা খোলা খালে পড়ে ৩ জন নিখোঁজ হন। পরে অটোরিকশার চালক সুলতান (৩৫) ও আরোহী খাদিজা বেগমের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
একই বছরের ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে পা পিছলে ড্রেনের পানিতে পড়ে ডুবে যান। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এর কিছুদিন বাদে ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ মোড়ে ড্রেনে পড়ে ১৯ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়ার মৃত্যু হলে আবার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এরপর ড্রেনের পাশে প্রথমে একটি অস্থায়ী বাঁশের বেড়া তৈরি করা হয়। পরে সেখানে ফুটপাত আটকে একটি ইটের দেওয়াল বসানো হয়। তবে কে বা কারা এই ইটের দেওয়াল তৈরি করেছে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কেউ এই দেওয়াল নির্মাণের কথা স্বীকার করেনি।
২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ড্রেনে পড়ে যায় ১০ বছর বয়সী কামাল উদ্দিন। নিখোঁজ হওয়ার ৩ দিন পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ড্রেনটিও এখনো অরক্ষিত থেকে গেছে।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিলও কালুরঘাটের ওসমানিয়া খাল থেকে এক নারীকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা।
চট্টেশ্বরী রোড এলাকার বাসিন্দা চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী তসলিমা আক্তার বলেন, 'সাদিয়ার মৃত্যুর কথা আমার এখনো মনে আছে। এই স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।'
বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমের আবারো এই ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তসলিমা।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ বড়ুয়ার ভাষ্য, 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ধরনের দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। দুর্ঘটনা রোধে তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ৫৭টি খালোর মোট দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার। আর ড্রেনের দৈর্ঘ্য ৭৬৫ কিলোমিটার।
সাদিয়ার মৃত্যুর পর সিসিসি গত বছর ড্রেন, খাল ও ফুটপাতের আশেপাশে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোর ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে ১৯ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে মোট ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত হয়।
তবে ঝুঁকিপূর্ণ এই জায়গাগুলা সুরক্ষিত করার অগ্রগতি খুবই কম। সিসিসি সূত্র বলছে, এর ৭০ শতাংশের বেশি কাজ এখনো শেষ হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে, সিসিসির প্রধান প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, খোলা ড্রেনের ওপর স্ল্যাব বসানো ও খালগুলোর পাশে সুরক্ষা দেওয়াল তৈরির কাজ চলছে।
তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত ড্রেনগুলোর ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গায় স্ল্যাব বসানো হয়েছে। আর খালগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে ১৫ হাজার বর্গফুট দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
Comments