সাইবার অপরাধের পেছনে যারা
দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন ২২ বছর বয়সী রাতুল শেখ। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১০ মার্চ ফরিদপুরের দুমাইন গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
রাতুলকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে তার কথা হয়।
তখন রাতুল জানান, তিনি প্রাথমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি।
'জমিতে কাজ করার পর আমি একটি দোকানে বসতাম। সেখান থেকেই হ্যাকিং কৌশল শিখেছি', বলেন রাতুল।
এ অপরাধে একই গ্রাম থেকে আরও ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। গ্রেপ্তারকৃত মোতালেব শেখ (২৪) পেশায় একজন কৃষক। অপর গ্রেপ্তার নাসির বিশ্বাস ওরফে তোতা (২৬) একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন।
তাদের কেউই স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি।
'ফিশিং লিংক' দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ২ অক্টোবর ওবায়দুর রহমান নোবেল (২০), শামীম সরদার (২১) ও সজিব খলিফাকে (২১) গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
গ্রেপ্তারকৃতরা ২ বছরে ২ হাজারেরও বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
তাদের মধ্যে নোবেল এসএসসি, শামীম চতুর্থ শ্রেণি ও সজিব তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
তারা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে হ্যাকিং কৌশল শিখেছিলেন।
সাইবার অপরাধে অপেশাদারদের জড়িত থাকার এই ধরনটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
ডিবির সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, 'ইমো, ফেসবুক ও এমএফএস অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া অপরাধীদের প্রায় ৮০ শতাংশই নন-টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের।'
তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশের বয়স ২৮ বছরের নিচে।
ডিবি কর্মকর্তাদের মতে, এ ধরনের অপরাধে তাদের জড়িত থাকার পেছনে কারণ হচ্ছে সহজেই ডিভাইস পাওয়া।
'দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে ডিজিটাল লিটারেসির অভাব রয়েছে। আর সেই সুযোগটিই নিচ্ছে অপরাধীরা', বলেন জুনায়েদ আলম সরকার।
আইন প্রয়োগকারীদের জন্য শেখার মাধ্যম
এটিএম বুথে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের প্রযুক্তি বা শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতা না থাকলেও ক্যাশ অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করার সময় তারা বুথ রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকের ২৩১টি বুথ থেকে অপরাধীরা প্রায় ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা লুট করেছে।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য করেছে, নিয়মিতই বুথ থেকে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে।
গত ৬ মার্চ দায়ের করা একটি মামলার পর এটিএম কেলেঙ্কারির পেছনে থাকা সিন্ডিকেটের ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী অপরাধের পদ্ধতি বর্ণনা করেন।
তিনি জানান, সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রথমে এটিএমে বান্ডেল করে টাকা লোড করত, যার পরে মেশিনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ডিপোজিট রিপোর্ট ইস্যু করে। কৌশলটি ছিল ২০ হাজার টাকার একটি বান্ডেলে কিছু নোট ভাঁজ করে দেওয়া।
এরপর ক্যাশ লোড ও মেশিনটি লক করার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৩ মিনিট এবং এই সময়টিই তারা কাজে লাগায়। এই ৩ মিনিটের মধ্যে তারা প্রায় ২১ হাজার টাকা করে একাধিক ডেবিট কার্ড পাঞ্চ করে, যখন পর্যন্ত মেশিনটি খোলা থাকে।
ভাঁজ করা নোটগুলো গণনার সময় মেশিনটি নগদ অর্থ দিতে সমস্যার মুখোমুখি হয়। এরপর লেনদেনটি ব্যর্থ হলেও নগদ অর্থ রিজার্ভ বক্সে যায়, যা থেকে অপরাধীরা তা সংগ্রহ করে। এ ধরনের পাঁচটি ব্যর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তারা ২০ হাজার টাকার বান্ডেলে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করে।
পরে, তারা মেশিন ও এটিএম কার্ডটি লক করে দিত, যেখান থেকে আগে টাকা ডেবিট করা হতো। ডিপোজিট রিপোর্ট পরিবর্তন না করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ক্রেডিট পেয়ে যেত। এই ফাঁকফোকরের কারণে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য মেশিনগুলো থেকে নগদ অর্থের ক্ষতির সন্ধান বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তাদের জন্য আয়োজিত এক কর্মশালায় এ ধরনের চাঁদাবাজির কৌশলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাইবার অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে।
পুনর্বাসন কি বাস্তবসম্মত?
পিবিআই প্রধান এআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সাইবার অপরাধীরা তরুণ এবং তাদের প্রশংসনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে।
'আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর তাদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া উচিত। তবে, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে এর জন্য সমন্বিত চেষ্টা করতে হবে', বলেন তিনি।
এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আইন প্রয়োগকারীদের সহায়তার জন্য গ্রেপ্তারকৃতদের পুনর্বাসনের পরে আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন মো. তারেক বলেন, 'যেহেতু তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রযুক্তিগত শিক্ষা নেই, তাই এই উদ্যোগটি হিতের বিপরীত হতে পারে।'
'তাদের অধিকাংশই ওপেন সোর্স থেকে কাজগুলো শিখেছে। তাদের অপরাধমূলক প্রবৃত্তিকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। যদি তাদের পেশাদার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে তারা আরও বড় ধরনের সাইবার অপরাধের জন্য তা ব্যবহার করতে পারে', যোগ করেন এই অধ্যাপক।
Comments