ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশ, পত্রিকা অফিসে হামলার অভিযোগ

নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় শনিবার দুপুরে ‘দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ’ পত্রিকা অফিসে হামলা হয়। ছবি: ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া/ সংগৃহীত

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশের জেরে নারায়ণগঞ্জের একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার অফিসে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের সমর্থকেরা এই হামলা করেছে।

আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় শহরের চাষাঢ়ায় 'দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ' পত্রিকা অফিসে হামলা হয়। 

এসময় অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে সন্ত্রাসীরা। এছাড়াও সম্পাদককে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়। 

পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক জাবেদ আহমেদ জুয়েল অভিযোগ করেন, 'আজমেরী ওসমানের সমর্থকেরাই এ হামলা চালিয়েছে।'

আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বর্তমান এমপি সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের ভাতিজা।

সংবাদপত্র অফিসের নিরাপত্তাকর্মী হাফিজ উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হঠাৎ করে শতাধিক লোকজন উপরে উঠতে শুরু করে। আমি তাদের বাধা দিতে গেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে যায়। পরে নিচে নেমে আমি সম্পাদককে ফোন দিয়ে জানাই।'

দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা। ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যক্ষদর্শী 'সময়ের নারায়ণগঞ্জ' এর স্টাফ রিপোর্টার আরিফ হোসাইন কনক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেলা ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে অফিসের নিচে শতাধিক মোটরসাইকেল অবস্থান করে। পরে তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। অফিসে ঢুকেই আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে। তারা গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকার লিড নিউজ 'যা ছিল খসড়া চার্জশীটে' সংবাদটি কেন প্রকাশ হয়েছে তার কৈফিয়ত জানতে চায়। সংবাদটি ছিল তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাবের দেওয়া খসড়া চার্জশিটের পুরোনো নিউজ। ওই নিউজ দেখিয়ে তারা বলতে থাকেন, 'তোরা আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে নিউজ করস। কালকের মধ্যে পত্রিকায় এর জন্য ক্ষমা না চাইলে পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দেব ও সম্পাদককে গুলি করে মেরে ফেলব।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা প্রায় ১৫ মিনিট অফিসে অবস্থান করে হুমকি দিতে দিতে চলে যায়। যাওয়ার সময়ে তারা অফিসে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেয়। সেই সঙ্গে অফিসে থাকা সিসি ক্যামেরার ডিভাইস খুলে নিয়ে গেছে। এছাড়া একটি পিসির হার্ডডিস্কও খুলে নিয়ে গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে।'

নারায়ণগঞ্জে দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে, অফিসের এক স্টাফের মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে অনেকের সঙ্গে নাসির ও আক্তার নূরকে দেখা যায়। এর আগে তারা একাধিকবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তারা পরিচিত।

এছাড়াও রাস্তার পাশে একটি মার্কেটের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার আগে শতাধিক লোকজন মোটরসাইকেলে করে শহর মহড়া দেয়। ওই মহড়া শেষ করেই পত্রিকা অফিসে যায়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম জানান, 'ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ, অফিসের লোকজনদের সঙ্গে থাকা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।'

দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জাবেদ আহমেদ জুয়েল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্প্রতি ত্বকী হত্যা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। ১১ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের সেই প্রকাশিত খসড়া চার্জশিট নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। মূলত সেই খসড়া চার্জশিট র‌্যাব প্রকাশ করে এবং ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি গণমাধ্যম কর্মীদের সরবরাহ করে। সেটিই হুবহু তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে আমাদের নিজেদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু তারা যেভাবে অফিসে হামলা করেছে সেটি ন্যাক্কারজনক। সাংবাদিক ও স্টাফদের বিভিন্ন হুমকি দিয়েছে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়া হবে।'

হামলাকারীরা কারা? জবাবে তিনি বলেন, 'এরা প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের সমর্থক। ত্বকীর ওই নিউজে আজমেরী ওসমানের নাম ছিল। সেজন্যই তারা এসে এ হামলা চালায়। হামলাকারীরা কৈফিয়ত দিতে বলে কেন আজমেরী ওসমানের নামে নিউজ করেছি। এতেই স্পষ্ট হয় যারা হামলা করেছে তারা আজমেরী ওসমানের সমর্থক।'

তিনি আরও বলেন, '৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আজমেরী ওসমানের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল করেছে যারা তারাই আজকে অফিসে হামলা করেছে।  ওই মিছিল থেকে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীকে হুমকি ধমকি দিয়েছে। কারণ ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ত্বকী হত্যার বিচার দাবিতে কর্মসূচিতে আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছে। সেই নিউজও আমরা প্রকাশ করি।'

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি। পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।'

অভিযোগ বিষয়ে মন্তব্যের জন্যে একাধিক বার আজমেরী ওসমানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, 'সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং জোরালো প্রতিবাদ করছি। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি যারা এই সংবাদকর্মীদের ওপর এবং সংবাদ অফিসে এভাবে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় হামলা চালিয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হোক। আমরা চাই না এরকমভাবে প্রকাশ্যে নারায়ণগঞ্জে কোনো ঘটনা ঘটুক। পত্রিকা পত্রিকার কাজ করবে আমরা আমাদের কাজ করব। যাহা সত্য তাহাই পত্রিকায় লেখে। অনেক সময় মিথ্যাও লেখে। তবে তার প্রতিবাদের ভাষা থাকবে একরকম। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড- দিয়ে নয়। আমরা নারায়ণগঞ্জের বুকে এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেখতে চাই না। আমি আবারো এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যেই পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। অনুরোধ জানাচ্ছি আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।'

নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি তা রিসিভ করেননি।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী শায়েস্তাখান সড়কের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। ৮ মার্চ সকালে চাড়ারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় গঠিত সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ ও ত্বকীর বাবা আজমেরী ওসমান জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছেন।

ত্বকী হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ৮ জনই পলাতক। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে দুইজন ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ইউসুফ হোসেন লিটন প্রথম ত্বকী মামলায় আদালতে জবানবন্দিতে সরাসরি জড়িত বলে স্বীকার করেন। তবে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উল্লেখ করে, ত্বকী হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন আজমেরী ওসমান। তবে ১৬ দিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর ভ্রমর তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেন।

Comments

The Daily Star  | English

Delaying elections lead to public concerns: Fakhrul

Criticising the chief adviser's recent suggestion to lower the voting age to 17, Fakhrul said the move would put the Election Commission (EC) on pressure.

1h ago