অনিয়মে নিমজ্জিত এক অধ্যক্ষ
মিরপুর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. গোলাম ওয়াদুদের বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপ ও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ভুয়া বিল তৈরি, ভাউচার ছাড়া টাকা দেওয়া, এক বছরেরও কম সময় আগে কেনা আসবাবপত্র মেরামতে খরচ, র্যালি ও শিক্ষা সফরের নামে অস্বাভাবিক ব্যয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রশিদ ছাড়া বিভিন্ন ফিস সংগ্রহ এবং নীতিমালা ভঙ্গ করে ৩৮ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া সবই করেছেন মো. গোলাম ওয়াদুদ।
দিনে দিনে বেড়েছে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ।
তার অনিয়ম এতটাই লাগামছাড়া হয়ে যায় যে কলেজের কিছু শিক্ষক বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। এক পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) তদন্ত করে এবং তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
তদন্তে বেরিয়ে আসে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অধ্যক্ষের সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত। এই প্রতিবেদন গত ৩০ জুন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
২১ আগস্ট কলেজের পরিচালনা পরিষদ ওয়াদুদকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এর কিছুদিন আগেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ওয়াদুদের এমপিও স্থগিত করে।
১৭ আগস্ট মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) আব্দুল কাদের একটি চিঠির মাধ্যমে জানান, ওয়াদুদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এবং অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার এমপিও সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে।
ওয়াদুদের উদ্দেশ্যে একটি কারণ-দর্শাও নোটিশও জারি করেন কাদের, যেখানে ওয়াদুদকে সাত দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে কেন তার এমপিও সুবিধা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হবে না।
আরেকটি চিঠিতে ওয়াদুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে মাউশিকে হালনাগাদ তথ্য জানাতে তিনি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতিকে অনুরোধ জানান। তবে এই মামলাটি এখনও দায়ের হয়নি।
কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি শরিফ এনামুল কবির মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ডিআইএর প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, কলেজের পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি, প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হক ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে ওয়াদুদকে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি কলেজের তহবিল তছরুপ করা শুরু করেন।
ডিআইএর তদন্তে জানা গেছে, আসলামুল হক ওয়াদুদকে নিয়োগ দেওয়ার সময় তিনি সেখানে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তৎকালীন উপাধ্যক্ষ এবং আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকদের টপকে তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এবং পরবর্তীতে তাকে অধ্যক্ষ করার ক্ষেত্রে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।
শিক্ষকরা বলেন, যেহেতু তিনি একজন সংসদ সদস্যের আশির্বাদপুষ্ট ছিলেন, তাই কেউ তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
অধ্যক্ষের পদে থাকার সময়টুকু ওয়াদুদ নিজেকে বিত্তশালী করার কাজে লাগান।
ডিআইএর তদন্ত থেকে জানা গেছে, ওয়াদুদ দুটি ব্যক্তিগত ঋণ নিয়েছেন, কিন্তু কোনটিই পরিশোধ করেননি। তার দুটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে এবং রাজধানীতে আরও একটি দুই হাজার ১০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং দেওয়ার জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন। এছাড়াও তার পুঁজিবাজার ও এফডিআরে ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
এছাড়াও তদন্তে আয়-ব্যয়ের হিসাবে ৫ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা গরমিল পাওয়া যায়।
চার সদস্যের দলটির প্রতিবেদনে ওয়াদুদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও কলেজের তহবিল তছরুপের ৩৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।
তিনি তার শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য কলেজ তহবিল থেকে পাঁচ লাখ, তার গ্রামের বাড়িতে একটি তিন তলা ভবন তৈরির জন্য তিন লাখ ও তার একটি অ্যাপার্টমেন্টে ফ্লোর টাইলস কেনার জন্য দুই লাখ টাকা নিয়েছেন।
ডিআইএর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি।
তিনি ২০১৩ সালে কলেজের একটি ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার সম্প্রসারণ কাজের জন্য নির্মাণ সামগ্রী কেনার ভুয়া রশিদ জমা দিয়ে ৬ দশমিক ৮ লাখ টাকা তছরুপ করেছেন এবং কলেজের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য পোশাক কেনার ভুয়া বিল জমা দিয়ে আরও ৯ দশমিক ৯৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
লিপি ফার্নিচার মার্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেঞ্চ কেনার মাত্র ১০ মাস পরেই সেগুলোকে মেরামতের জন্য ১৫ দশমিক ৪ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।
একাধিক শিক্ষক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, লিপি ফার্নিচার মার্টের মালিক একজন আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি সংসদ সদস্যের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
তারা জানান, আসবাবপত্রের দোকানটি কলেজের একটি ভবন রঙ ও সংস্কার করার কাজ পেয়েছে।
ডিআইএর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কোন ধরণের টেন্ডার ছাড়া লিপি ফার্নিচার মার্ট বিভিন্ন সময়ে ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে যেটি নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে এবং তা নিশ্চিতভাবেই অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
এছাড়াও তদন্তে লিপি ফার্নিচার মার্টকে ১০ দশমিক ৮০ লাখ টাকার বিল দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু তার সঙ্গে কোন রশিদ সংযুক্ত করা ছিল না।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, কোন ধরণের টেন্ডার ছাড়াই কলেজের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য ১০ দশমিক ১৭ লাখেরও বেশি টাকা খরচ এবং উন্নয়ন উপ-কমিটির সদস্যদের সম্মানী বাবদ ১২ দশমিক ৩৩ লাখ টাকা বিতরণের ঘটনাগুলো নীতিমালার বিরুদ্ধে যেয়ে করা হয়েছে।
ওয়াদুদ অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে ১৮ দশমিক ৪৯ লাখ টাকা ব্যয় করে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে একটি পথ সমাবেশের আয়োজন করা হয় এবং শিক্ষা সফরের পেছনে আরও ছয় দশমিক ৪৫ লক্ষ টাকার খরচ দেখানো হয়, যেগুলো একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং অপব্যবহারের সমতুল্য।
ডিআইএর তদন্তে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র, ফি বুক ও কোচিং ফি এর বিপরীতে কোনো টাকা আদায়ের রশিদ দিতো না।
ওয়াদুদ অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে নীতিমালা ভঙ্গ করে ১৯ জন পূর্ণকালীন ও ১৯ জন খন্ডকালীন শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কলেজের একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, অধ্যক্ষ পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি ও এমপি আসলামের সঙ্গে যোগসাজশে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন।
ডিআইএর প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, প্রায় ২৪ দশমিক ২৫ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিচয় পত্রের পেছনে ৮০ থেকে ৯০ টাকা করে খরচ হয়েছে, কিন্তু তদন্ত থেকে সুনির্দিষ্ট ভাবে কত টাকা খরচ হয়েছে তা বের করা সম্ভব হয়নি।
দ্য ডেইলি স্টার পরিচয় পত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইডেন্টিটি সোর্সের মালিক আরমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি জানান তারা প্রতিটি পরিচয়পত্রের জন্য ৬০ টাকারও কম নিয়ে থাকেন।
কলেজ শিক্ষকরা বলেন, এ ধরনের পরিচয় পত্র বাজারে ৩৫ টাকায় পাওয়া যায়।
গোলাম ওয়াদুদের বক্তব্য
গোলাম ওয়াদুদ বলেন, ডিআইএর প্রতিবেদনটি ভুয়া এবং তিনি পুনঃতদন্তের আবেদন জানাবেন।
গত ৮ জুলাই তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছেন, 'কমিটির জন্য তিন দিনের মধ্যে নয় বছরের সকল রশিদ ও কাগজপত্র জোগাড় করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।'
তিনি জানান, সব কাগজপত্র তার হাতে আছে এবং তিনি ডিআইএর প্রতিবেদনটি পেলে পুনঃতদন্তের জন্য আবেদন জানাবেন।
ডিআইএর প্রতিবেদনে উল্লেখ তিনটি অ্যাপার্টমেন্টের ব্যাপারে ওয়াদুদ জানান, তিনি ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটি (মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ে) কিনেছেন এবং ২০১৪-১৫ সালে লটারির মাধ্যমে স্বপ্ননগর প্রকল্প থেকে সরকারি অ্যাপার্টমেন্টটি পেয়েছেন।
তিনি উদয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টের বুকিং দেওয়ার কথাও স্বীকার করেন।
কলেজের মার্কেটিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ওয়াদুদ জানান, তিনি অ্যাপার্টমেন্টগুলো ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও পারিবারিক সহায়তার মাধ্যমে কিনেছেন।
তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোরে একটি দোতলা ভবনে, যেটিকে তারা এখন সংস্কার করে তিন তলা করছেন।
গুরুদাসপুরের দরিহাসমারিতে অবস্থিত ওয়াদুদের পৈত্রিক বাসস্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই সংবাদদাতা তাদের পূর্বতন দোতলা বাড়ির পাশে একটি নবনির্মিত তিন তলা দালান দেখতে পান।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments