‘নিপীড়নমূলক আইন কার্যত শাসক শ্রেণি ও বিত্তবানদের স্বার্থ রক্ষা করে’
অবৈধ ও নিপীড়নমূলক আইন কার্যত রাষ্ট্র, শাসক শ্রেণি, ক্ষমতাধর ও বিত্তবানদের স্বার্থই রক্ষা করে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার।
আজ শনিবার সকাল ১১টা থেকে শুরু হওয়া এক অনলাইন নাগরিক সভায় তিনি এ কথা বলেন।
মানবাধিকার সংগঠন নাগরিকের আয়োজনে 'সাম্প্রতিক খসড়া আইন-নীতিমালাসমূহে নাগরিক অধিকার প্রশ্ন' শিরোনামে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নাগরিকের আহ্বায়ক ড. সি আর আবরারের সভাপতিত্বে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, সালেহ আহমেদ, তাসনুভা আনান শিশির, সুস্মিতা এস পৃথা, বেলায়াত হোসেন মামুন।
সভায় জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যে সকল অঙ্গীকার আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুনেছি, নির্বাচনের বিভিন্ন অঙ্গীকার যা আমরা শুনেছি, সে বিষয়ে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে কতটুকু এগিয়েছে ইন্টারনেট স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে তার নমুনা পাওয়া যাবে ৫টি প্রস্তাবিত নীতিমালা ও আইনে। এগুলো নাগরিকদের হতাশাজনক মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকুচিত করবে এবং নাগরিক অধিকার হরণের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।'
সভার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন। এতে প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা (খসড়া) আইন ২০২২, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নিয়ে খসড়া নীতিমালা ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের খসড়া এবং সংসদে উপস্থাপিত বৈষম্য বিরোধী আইন ২০২২ ও গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন বিষয়ে বলা হয়।
তিনি বলেন, '২০২১ ও ২০২২ সালে বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় আইন, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এই ৫টি নতুন আইন ও নীতিমালা প্রস্তাব করেছে। এ সকল নীতিমালা-আইন নাগরিকদের প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক অংশগ্রহণ ছাড়াই প্রস্তুত করা হয়েছে।'
ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, 'নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তা মারাত্মক আত্মঘাতী প্রক্রিয়া।'
বৈষম্য বিরোধী আইনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, 'এই আইনে যাদের কারণে নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তাদের কাছেই আবার আবেদন করার নিয়ম রাখা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলেও আর উচ্চ আদালতে সাংবিধানিক অধিকার চেয়ে মামলা দায়ের করা যাবে না। মূলত রিট মামলার ক্ষেত্রে এটি একটি আইনগত বাধা।'
শিল্পী ও মানবাধিকার কর্মী তাসনুভা আনান শিশির জানান, নাগরিক হিসেবে কর্মক্ষেত্রসহ সবক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করায় তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে দেশের সব যায়গায় তিনি এবং তার কমিউনিটি বার বার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'তাহলে নাগরিক হিসেবে আমার অধিকার নিশ্চিত হলো কোথায়? আমার বা আমাদের ফিক্সড কোনো শব্দ বা ডেফিনিশন নেই, যে ডেফিনেশনের আলোকে লিখতে পারি, আমরা কে, আমি কে। ২০২২ সালের স্বাধীন দেশের নাগরিক আমি, অথচ আমার কোনো পরিচয় নেই?'
বৈষম্য নিরোধ আইন ২০২২ নিয়ে তিনি বলেন, 'এখানে ২টি শব্দ স্পষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে—প্রথমটি প্রতিবন্ধী এবং দ্বিতীয়টি তৃতীয় লিঙ্গ। প্রতিবন্ধী শব্দটি কখনো ব্যক্তি হিসেবে বলা হয়েছে কখনো হয়নি। এই শব্দ ২টি দিয়ে এখানেই বৈষম্য তৈরি হয়েছে।'
চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া) এর আইনি ধারণার সংজ্ঞায়নে স্বল্পতা এবং অস্পষ্টতার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, 'যদিও প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে "চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের সুবিধার্থে ওটিটি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করিবার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করিতে সরকার বদ্ধপরিকর।" আইন করছে রাষ্ট্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের এবং খসড়া প্রণয়ন করছে সরকারি কর্মকর্তারা। এর বিষয়ে আলোচনা কি নাগরিকদের সঙ্গে হয়েছে? হলে পর্যাপ্ত এবং যথার্থ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি? সরকার কিংবা রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দেশীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ কেমন করে বা কোন নিক্তি দিয়ে পরিমাপ করবে?'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযাচিতভাবে সেন্সরশিপ, ব্লক, ফিল্টারিং করা হচ্ছে। সাইবার বুলিং ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন অনেকে। নারী ও শিশুরাও সাইবার স্পেসে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এটি শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, একই সঙ্গে জীবনের অধিকারেও পরিণত হচ্ছে। যে আইনি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে তাতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নেই এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়াও খুব বেশি আনন্দজনক নয়।'
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'ইন্টারনেট নজরদারির জন্য এত আইন রয়েছে, এগুলোর প্রয়োগ আমাদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে কেন দেখা যায় না? কেননা এই বিধিমালায় হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের এনস্ক্রিপটেড কোনো তথ্য যাবে না, এমন কথাও বলা হয়েছে। এর অর্থ কর্তৃপক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রবেশাধিকার চায়। এনক্রিপশন না থাকলে কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় যে কারো আলাপে ঢুকে পড়তে পারবে।'
খসড়া গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন ও বৈষম্য বিরোধী আইনের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'নতুন আইনে গণমাধ্যম কর্মীদের সুরক্ষিত হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আইনটি প্রণয়নের সময় সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ থাকলে এমন শুভঙ্করের ফাঁকি তৈরি হতো না। এই আইনের ফলে সাংবাদিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাতে পারেন। ফলে দাবি আদায়ের জন্য তারা আন্দোলন করতে পারবেন না। এমনকি নানা উছিলায় তারা চাকরি হারাতে পারেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের সপ্তাহে দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম রাখা হয়েছে। অথচ বিশ্বজুড়েও পূর্ণকালীন চাকরি বলতে ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ বোঝানো হয়।'
বৈষম্য বিরোধী আইন নিয়ে তিনি বলেন, 'এই আইনে বেশ ভালো ভালো কিছু কথা থাকলেও সত্যিকারের ভুক্তভোগী কোনো প্রতিকার পাবেন না। বিভিন্ন লেয়ার সৃষ্টি করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করে মূলত প্রতিকার না পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইনে এমন কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে যা বৈষম্যমূলক, এটি দুঃখজনক।'
সভাপতির বক্তব্যে সি আর আবরার বলেন, 'আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সমস্যা নানামুখি এবং এটি মোকাবিলার জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা ও আইন প্রণয়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজন আছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোগুলো যে ব্যর্থ হচ্ছে তা আজকের বক্তাদের কথার মাধ্যমে উঠে এসেছে। এ কারণে জবাবদিহিতা আনার প্রয়োজন রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ইন্টারনেট নীতিকে আন্তর্জাতিক আইন ও মূলনীতিগুলো সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পালন করা এবং অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট যাতে একটি উন্মুক্ত ফোরাম ও জনপরিসর হিসেবে থাকে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইন প্রণয়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণ, পর্যালোচনায় সমতার সুযোগ, নাগরিকদের নিকট দায়বদ্ধতা ছিল শূন্য থেকে মহাশূন্যময়। যার ফল সরাসরিভাবে মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিকরা ভোগ করেছেন, করছেন এবং করবেন।'
Comments