চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক টানাপড়েনে ‘ভুক্তভোগী’ বোয়িং

বোয়িংয়ের ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজের উড্ডয়ন স্থগিত করেছে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স। ছবি: এএফপি

সম্প্রতি চীনে এক ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আরও একটি বোয়িং উড়োজাহাজ ভূপাতিত হয়েছে। এ ঘটনার পর বোয়িংয়ের এ মডেলের সব উড়োজাহাজের উড্ডয়ন কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরে নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছে মার্কিন বহুজাতিক উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং।

সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোয়িংয়ের ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজের উড্ডয়ন স্থগিত করেছে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স। এই উড়োজাহাজ সংস্থার পরিচালিত একটি ফ্লাইট ২১ মার্চ ভূপাতিত হয় এবং ১৩২ যাত্রীর সবাই নিহত হন। এই দুর্ঘটনার পেছনের কারণ এখনো জানা যায়নি।

দুর্ঘটনার কারণ যান্ত্রিক ত্রুটি না হলে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

তবে এটিই চীনে বোয়িংয়ের জন্য একমাত্র মাথাব্যথার কারণ নয়।

উড়োজাহাজ চলাচলের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীন। সেদেশে ইতোমধ্যে বোয়িং আরও বেশ কিছু সমস্যায় ভুগছে। গত ৪ বছরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে সেদেশে বোয়িংয়ের বিক্রয় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বোয়িং চীনের কাছে উড়োজাহাজ বিক্রির ঘোষণা দেয়।

অথচ মাত্র ৬ মাস আগেও, গত সেপ্টেম্বরে বোয়িং পূর্বাভাস দিয়েছিল, আগামী ২০ বছরে চীনে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ বাজারের মূল্যমান ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

নতুন অর্ডার না পেলেও আগের অর্ডার অনুযায়ী বোয়িং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে উড়োজাহাজ সরবরাহ করেছে। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে ২টি ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের নকশার ত্রুটি চিহ্নিত হয়। ফলে বোয়িংয়ের সর্বাধিক বিক্রিত মডেল ৭৩৭ ম্যাক্স'র উড্ডয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিশ্বের বিভিন্ন উড্ডয়ন কর্তৃপক্ষ। প্রায় ২০ মাস ধরে চলে এই নিষেধাজ্ঞা।

এসময়ের মাঝে চীনে মাত্র ৪০টি উড়োজাহাজ সরবরাহ করেছে বোয়িং।

অবশেষে ২০২০ সালের নভেম্বরে মার্কিন উড্ডয়ন কর্তৃপক্ষ ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এরপর অন্যান্য দেশেও এই উড়োজাহাজ আবারো উড়তে শুরু করে।

তবে চীনে আরও এক বছর পর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও দেশটির কোনো উড়োজাহাজ সংস্থা এখন পর্যন্ত এ মডেলের উড়োজাহাজকে তাদের নিয়মিত ফ্লাইটে ফিরিয়ে আনেনি।

গবেষণা সংস্থা মেলিয়াস রিসার্চ এক বিবৃতিতে জানায়, সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ আবারো নিয়মিত ফ্লাইটের অংশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

গুরুত্বপূর্ণ বাজার চীন

গত ৩ বছরে একেরপর এক সমস্যায় ভুগে বোয়িংয়ের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বেশ নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারানো তাদের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করতে পারে। পরপর ২টি ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পড়া এবং করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে সৃষ্ট মন্দায় ফ্লাইটের চাহিদা শূন্যের কোঠায় চলে যায়। ফলে বিশ্বের অন্য সব উড়োজাহাজ সংস্থার মতো বোয়িংও আর্থিক সংকটে ভুগতে থাকে।

অল্প কিছুদিন আগে তাদের সর্বশেষ মডেল ৭৩৭ ড্রিমলাইনারেও ত্রুটি ধরা পড়েছে। ফলে অনেক দেশ অর্ডার দেওয়া সত্ত্বেও এ মডেলের চালান স্থগিত করেছে।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে বোয়িংয়ের বৈশ্বিক উড়োজাহাজ অর্ডারের ২০ শতাংশ চীন থেকে আসলেও, ২০২০ সালের শুরুতে এই হার ৫ শতাংশে নেমে আসে। উড়োজাহাজ সরবরাহ থেকেই বোয়িংয়ের সিংহভাগ রাজস্ব আসে।

কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, বৈরি পরিস্থিতিতেও গত ৪ বছরে বোয়িং কিছু চীনা উড়োজাহাজ সংস্থার সঙ্গে উড়োজাহাজ বিক্রির চুক্তি করেছে।

উড়োজাহাজ বিষয়ক উপদেষ্টা সংস্থা অ্যারোডায়নামিক অ্যাডভাইজারির বিশ্লেষক রিচার্ড আবুলাফিয়া জানান, চীন সরকার এই অর্ডারগুলোকে আনুষ্ঠানিক ছাড় দেয়নি, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সার্বিক বাণিজ্য আলোচনায় উড়োজাহাজ বেচা-কেনার বিষয়টিকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী।

গত অক্টোবরে বোয়িংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভ কালহুন বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, 'আমরা চীনের গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের উড়োজাহাজ সংক্রান্ত চাহিদা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।'

'এ ছাড়াও, সব ধরনের বাণিজ্যিক বিভেদ দূর করার জন্য আমরা উভয় দেশের নেতৃবৃন্দকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ জানাচ্ছি', যোগ করেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশগুলো যত দীর্ঘ হবে, ততই ঝুঁকিতে পড়বে বোয়িং। একপর্যায়ে হয়তো তাদেরকে চীনের বাজার থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যেতে হবে।

সাধারণত উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো এক নির্মাতা থেকে আরেক নির্মাতার কাছে যেতে চান না, কারণ এত বড় একটি পরিবর্তনের সঙ্গে চলে আসে বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ ও খুচরো যন্ত্রাংশের বাড়তি খরচের বিষয়টি। সুতরাং চীন সরকার বাধ্য না করলে খুব সহজে দেশের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো বোয়িংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ারবাসের কাছ থেকে নতুন উড়োজাহাজ কেনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

যদি বোয়িং দীর্ঘমেয়াদে চীনের বাজার হারায়, তাহলে তাদেরকে পাকাপাকিভাবে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ খাতের দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যেতে হবে। মূলত এই খাতের বেশিরভাগ ব্যবসা এয়ারবাস ও বোয়িং নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

এতদিন মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িং এই খাতের শীর্ষে অবস্থান করছিল। তবে চীনের বাজার পরিবর্তনের কারণে ইউরোপভিত্তিক এয়ারবাস চলে যেতে পারে শীর্ষে। বিশ্লেষকরা এমনটাই ভাবছেন।

Comments

The Daily Star  | English

14 arrested over attacks, clashes in Gopalganj

At least 14 people have been arrested so far in connection with yesterday’s attack on NCP rally and subsequent clashes with law enforcers

19m ago