ঋণের চক্রে আবর্তিত বস্তিবাসীর ভাতের থালায় টান
কাজ ছাড়া দীর্ঘ সময় চলার মতো সরকারি সহায়তা নেই। বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের ত্রাণ সহযোগিতাও অপ্রতুল। উপরন্তু দেড় বছর ধরে চলা করোনাভাইরাস মহামারির ধকল কাটাতে বিভিন্ন এনজিও ও বস্তির মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের ঋণ যখন ঢাকার বস্তির বাসিন্দাদের জীবনের ওপর চেপে বসেছে, তখনই আবার এসেছে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা।
এই পরিস্থিতিতে জীবিকা অর্জনের সব পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজধানীর দরিদ্র বস্তিবাসীদের ভাতের থালায় টান পড়েছে এখন। দিশা না পেয়ে অনেকে ছুটছেন গ্রামের দিকে। আর যেসব উন্মূল মানুষদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও বৃহৎ ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি ঢাকার কড়াইল, ভাষানটেকসহ মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার এমন করুণ চিত্র চোখে পড়েছে।
এসব বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, নতুন করে আরোপিত এই লকডাউন মারাত্মক আঘাত হয়ে এসেছে তাদের ওপর। ক্ষুধা এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে মে’র শেষ পর্যন্ত সাধারণ ছুটির ভেতর তাও অনেকে নগদ অর্থ, খাদ্য কিংবা ত্রাণসামগ্রী দিয়ে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু, এবার এর কিছুই নেই।
ঢাকার বস্তিগুলোতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ঠিক কত, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সরকারের ২০১৪ সালের শুমারি বলছে, ঢাকার দুই সিটির মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ছয় লাখের মতো মানুষ বস্তিতে বসবাস করে।
অবশ্য এই পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক আছে। ২০১৫ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের করা ‘আরবান হেলথ সিনারিও: লুকিং বিয়ন্ড ২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরে বাস করা মানুষের ৩৫ শতাংশই বস্তিবাসী। আবার বেসরকারি সংস্থা নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস) ২০০৫ সালে ঢাকা মহানগর এলাকায় পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে জানায়, এই শহরে বস্তিবাসীর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি।
এ বিষয়ে আজ শুক্রবার নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখন বস্তিবাসীর সংখ্যা কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু, পার্থক্যটা খুব বেশি হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।’
ঢাকায় বস্তিতে বসবাসরত বাসিন্দাদের বেশিরভাগ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি আছেন শহর এলাকায় নির্মাণকাজ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক, রিকশাচালক এবং লঞ্চ ও নৌ-খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা, হকার, চা বিক্রেতা, খাবারের দোকানের মালিক ও সারাইকারীদের অবস্থাও ভালো না।
সম্প্রতি ঢাকার কড়াইল ও ভাষানটেকসহ অন্তত পাঁচটি বস্তি এলাকা ঘুরে এর শতাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। দেখা গেছে, চলমান বিধি-নিষেধের মধ্যে তাদের বেশিরভাগই কাজ হারিয়েছেন। এখন তাদের জীবন কাটছে তীব্র অনটনের ভেতর দিয়ে।
গত ৫ জুলাই রাত ১২টার দিকে কড়াইল বস্তির জামাইবাজার এলাকায় কথা হয় মুদি দোকানদার আলকাস মিয়ার (৬০) সঙ্গে। প্রায় মধ্যরাতে তিনিসহ জনাত্রিশেক ব্যক্তি একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
আলকাস বলেন, ‘দোকানে বিক্রি নাই। লকডাউনে আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপরে ঋণের বোঝা। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।’
সেসময় সেখানে উপস্থিত প্রায় প্রত্যেকেই জানালেন তাদের অর্থকষ্ট ও খাদ্যাভাবের কথা। আবার স্বাস্থ্যবিধি না মেনে আড্ডায় শামিল হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই একজন বলে উঠলেন, ‘পুরো এলাকা ঘিঞ্জি। এখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব না। আর খাবারের কষ্ট তো করোনার চাইতে বড়।’
কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির বউবাজার ইউনিটের চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বস্তি এলাকার বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর, হোটেল কর্মচারী, ফুটপাতের দোকানদার, নির্মাণশ্রমিক। অনেকে আবার ভিক্ষা করেন। লকডাউনের কারণে কাজ না থাকায় বেশিরভাগ মানুষেরই দুই বেলা খাবার জোগাড় করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
কড়াইল বস্তির এই নেতা জানান, দিন ১৫ আগে একটি এনজিও থেকে বস্তির দুই হাজার পরিবারের জন্যে ত্রাণ হিসেবে চাল, ডাল, তেল, লবণ, ইত্যাদি দেওয়া হয়। কিন্তু, এই বস্তিতে প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের বাস। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের জন্যে বস্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি সহযোগিতা পৌঁছায়নি।
আবদুস সোবহান আরও বলেন, ‘গত বছর লকডাউনের ধাক্কা সামলাতে অনেকে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করার জন্যে পরে সুদের কারবারীদের কাছ থেকে আরও চড়া সুদে টাকা ধার নেয় তারা। এভাবে অনেকে ঋণের চক্রে পড়ে বাড়িতে চলে গেছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা নতুন করে টাকা ধার করছে।’
খাবার ও ত্রাণ সহায়তার জন্যে জরুরি হটলাইন ৩৩৩ নম্বরে ফোনের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুস সোবহান বলেন, ‘এ বিষয়ে বস্তির কেউ কিছু জানে না।’
গত মঙ্গলবার মিরপুরের ভাষানটেক ও মহাখালীর সাততলা বস্তি এলাকায় ঘুরেও একই রকম চিত্র দেখা যায়।
ভাষানটেকের ‘আবুলের বস্তি’ এলাকার আবুল ডেইলি স্টারকে জানান, লকডাউনে এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অভাব-অনটনেদিন কাটছে তাদের।
এর আগে ৪ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার চা ও খাবারের দোকানগুলোর সামনে প্রচুর মানুষের ভিড়। সড়কে ঋণের টাকা নিয়ে ঝগড়া করছেন কয়েকজন।
বিহারী নেতা ও জেনেভা ক্যাম্পের মহাজির রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্টের সভাপতি ওয়াসি আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত এপ্রিলে ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়ে কিছু ত্রাণ পেয়েছিলাম। এখন নম্বরটিতে ফোন ঢুকছে না। দুই-তিন দিন চেষ্টা করে পরে কল করা বাদ দিয়েছি।’
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, বস্তির প্রতি বর্গফুট জায়গার ভাড়া যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট ভাড়ার চেয়ে বেশি। আবার শহরের সুবিধাভোগী নাগরিকদের চাইতে সরকারি সংস্থার বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি তাদের কিনতে হয় বাজারমূল্যের চাইতে বেশি দরে। যেহেতু সেসব তাদের অবৈধ পথে পেতে হয়।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বস্তিবাসীরা মৌলিক সব সেবা থেকে বঞ্চিত। যেখানে বঞ্চনা বেশি, সহায়তা সেখানেই বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু, বস্তিবাসীদের বেলায় আমরা উল্টোটাই দেখি।’
Comments