যেভাবে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ

গত সাত বছরের চেষ্টায় চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে এনেছে প্রতিবেশি ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ছবি: এএফপি

“সাতদিনে একদিন জমা জল ফেলে দিন”; বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এই স্লোগান নিয়ে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ে তেমন সফলতা না পেলেও চিকুনগুনিয়া জ্বর রুখতে অনেকটাই সফল হয়েছে রাজ্যটি। চলতি বছরে সরকারিভাবে ২৩ জেলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বসবাস রাজ্যটিতে চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের কোনো তথ্য নেই।

এমন কি ২০০ বর্গ কিলোমিটারের রাজ্যের বৃহত্তম পৌর সংস্থা কলকাতা করপোরেশনেও এডিস মশা বাহিত চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের তথ্য নেই এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতর এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, মশা নিধনে বছরের ৩৬৫ দিনই অতি সক্রিয় থাকছে এখানকার প্রশাসন। আর সে কারণে সাত বছর আগেও যেখানে চিকুনগুনিয়ায় ভারতের শীর্ষ রাজ্যের জায়গা পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সাত বছর পরে শুধুমাত্র সচেতনতা বাড়ানো, পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে এই রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব হয়েছে ৮০ শতাংশ।

তবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুও নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান গত সাত বছরের তেমন তারতম্য হয়নি। বরং তুলনামূলকভাবে আশঙ্কাজনক অবস্থানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। গত কয়েক দিন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমন তথ্যই পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার প্রতিনিধি।

আরও পড়ুন: চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে যা জানা দরকার

কলকাতা করপোরেশনের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা টিকে মুখার্জি এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শুধু বর্ষাকাল এলেই এখানে (পশ্চিমবঙ্গে) মশা মারায় উদ্যোগী হয় না রাজ্য সরকার। মশা মারতে সারা বছরই কর্মযজ্ঞ চলে। আর যেহেতু চিকুনগুনিয়া জীবাণুবাহী এডিস মশার উৎসস্থল থেকেই এর বিনাশ করা হয়, তাই এই রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব হয়েছে।

তিনি একটা উদাহরণ টেনে বলেন, মনে করুন ঢাকা থেকে একজন চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কলকাতায় আসেন তবে কলকাতায় চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়বে এমনটা ভাবার কারণ নেই। কারণ ওই জ্বরের জীবাণু বহনকারী এডিস মশাই নেই এখানে। এডিশ মশা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রক্ত খেয়ে যদি অন্য কারো শরীরের রক্ত খায় তবেই চিকুনগুনিয়া হতে পারে। যেখানে এডিস মশাই নেই- সেখানে এমন আশঙ্কা করার কোনো যুক্তি নেই।

সচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই সরকার কিংবা পৃষ্ঠপোষকদেরও সমানভাবে সচেতন হয়ে উদ্যোগী হতে হবে। অবকাঠামোর উন্নয়ন, আধুনিক ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে মশা নিধন করতে হবে। অভিজ্ঞ পতঙ্গবিদ নিয়োগ করে প্রকৃত এডিস মশা সনাক্ত করার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এই কথাগুলোও যোগ করেন ডাক্তার টিকে মুখার্জি।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, মাত্র সাত বছর আগে ভারতে চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছিল সবার আগে। ২০১০ সালে চিকুনগুনিয়ায় ৪৮ হাজার ১৭৬ জন আক্রান্তের মধ্যে ২০ হাজার ৫০৩ জনই ছিল পশ্চিমবঙ্গের। সাত বছর পর ২০১৬ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মধ্যে মাত্র এক হাজার ৭১ জন মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চলতি বছরে আক্রান্তের কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে।

রাজ্যের মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিশ্বরঞ্জন ছঁপতি এই প্রসঙ্গে যোগ করেন যে, সারা বছর সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে যাওয়ার জন্যই এমন সুফল মিলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর থেকে রাজ্য জুড়ে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া রোগ নিয়ে প্রচার প্রচারণা শুরু করে রাজ্য সরকার এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। যেমন করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত এমনকি থানা ও জেলা প্রশাসনের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন সামাজিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন, খেলার ক্লাব কিংবা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগেও মশাবাহিত রোগ নিয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা হয় সারা বছর।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছর এখনও সরকারিভাবে পশ্চিমবঙ্গে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালে রাজ্য থেকে এক হাজার ৭১ আক্রান্তের তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। একইভাবে আগের বছর ২০১৫ তে এক হাজার ১৩ জনের রক্তে চিকুনগুনিয়ার জীবাণু সনাক্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে এক হাজার ৩২, ২০১৩ সালে ৬৪৬, ২০১২ তে এক হাজার ৩৮১, ২০১১ সালে সারা ভারতে ২০ হাজার ৪০২ জন আক্রান্তের মধ্যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ছিল চার হাজার ৪৮২ জন। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২০ হাজার ৫০৩ জনের রক্তে পাওয়া যায় চিকুনগুনিয়ার জীবাণু এবং সারা ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ১৭৬ জন।

তবে ডেঙ্গু নিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে অন্য কথা। যেমন, চলতি বছরের পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৮১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই। ডেঙ্গু নিয়ে সাত বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ছিল গত বছর। গত বছর ২২ হাজার ৮৬৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় ও তাদের মধ্যে ৪৫ জন মারা যায়।

এর আগের বছর মৃতের সংখ্যা ছিল ১৫, আক্রান্তের সংখ্যা আট হাজার ৫১৬ জন। ২০১৪ সালে তিন হাজার ৯৩৪ জনের মধ্যে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছেন চার জন। একইভাবে আগের বছর মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ছয়। ২০১২ সালে পাঁচ হাজার ৯২০ জনের আক্রান্তের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়।

২০১১ সালে পাঁচ হাজার ১০৩ জনের আক্রান্তের মধ্যে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এবং ২০১০ সালে ৮০৫ জনের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন মাত্র এক জন।

কলকাতার বিধাননগর এলাকার বাসিন্দা মহুয়া মিত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মৃত্তিকা আচার্য, সংবাদ কর্মী মুকুল বসুর মতো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বাড়ি কিংবা অফিস যেখানেই জল জমে থাকে সেই জায়গা তারা দ্রুত পরিষ্কার করেন। এমনকি প্লাস্টিকের পাত্র, কিংবা চা খাওয়ার ভারও তারা যেখানে সেখানে ফেলেন না।

কলকাতা করপোরেশনের মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতিন ঘোষ বলেন, এডিস মশার লার্ভা হয় স্বচ্ছ জমা জলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্লাস্টিকের প্যাকেট, মাটির ভার কিংবা প্লাস্টিকের কাপে জমে থাকা জলেই এডিস মশার লার্ভা জন্ম হয়। আমরা এই বিষয়গুলোকেই প্রচারে আনার চেষ্টা করি সবসময়।

Comments

The Daily Star  | English

Fire service & civil defence: High-risk job, low pay

Despite risking their lives constantly in the line of duty, firefighters are deprived of the pay enjoyed by employees of other departments, an analysis of their organograms shows.

8h ago