অর্থ লুটপাটে পি কে হালদারের চাতুর্য ছিল বোধগম্যের বাইরে

প্রশান্ত কুমার হালদার। ফাইল ছবি

চারটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের চাতুর্য ছিল যে কারো বোধগম্যের বাইরে।

ঋণ নেওয়ার নামে এই অর্থ আত্মসাতের জন্যে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে নিজের অনুগত লোকদের বসিয়েছিলেন।

সেই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএস)। এর চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে পি কে হালদারের চাতুর্যের বিষয়টি জানা যায়।

পি কে হালদারের সৃষ্ট দুই ডজনের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্যে ওইসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। অথচ বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ছিল অস্তিত্বহীন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই ঋণের টাকা থেকেই ওইসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের কিস্তি তিনি পর্যায়ক্রমে শোধ করতেন।

গত সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিমের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে উজ্জ্বল জানিয়েছেন, অর্থ আত্মসাতের ঘটনা গোপন করতে পি কে হালদার এমন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন।

চলতি মাসের শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হকও আদালতে একইরকম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার ও তার লোকেরা আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাশেদুল স্বীকারোক্তিতে বলেন, পি কে হালদারের নির্দেশনায় হাজার কোটি টাকা তিনি ঋণ হিসেবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে বিতরণ করেছেন।

২০১৯ সালে দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে পি কে হালদারের অনিয়ম দৃশ্যপটে আসে।

২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হালদার ও তার লোকেরা পিএলএফএস, আইএলএফএসএল, এফএএস ফাইন্যান্স ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলো চরম সংকটে আছে। এগুলোর মধ্যে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে পিএলএফএস।

বাকি তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা অর্থ তুলতে বেশ কয়েকটি ব্যাংককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। কয়েক বছর আগে এই ব্যাংক দুটি পিএলএফএস, এফএএস ফাইন্যান্স ও আইএলএফএসএল’র কাছে কয়েক শ কোটি টাকা জমা রেখেছিল।

দুটি ব্যাংকই তাদের অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছে। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

উজ্জ্বল তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আসলে পিএলএফএসের চেয়ারম্যান হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই আমার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করতে পি কে হালদার আমাকে এই পদে বসিয়েছিলেন।’

পিএলএফএস থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠেছে বর্তমানে কানাডায় থাকা পি কে হালদারের বিরুদ্ধে।

উজ্জ্বলের অভিযোগ, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পিএলএফএস’র চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম হোসেনকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে সেই পদ থেকে সরিয়েছিলেন পি কে হালদার।

তিনি বলেন, ‘ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম সেই পদ ছেড়ে দিলে আমি ২০১৫ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে অভিষিক্ত হই।’

উজ্জ্বল ২০০৮ সালে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিএল এ ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর তিনি ২০১০ সালে গোল্ডেন ইন্সুরেন্সে চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসারের পদে যোগ দেন।

২০১৩ সালে সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন উজ্জ্বল। ফ্রিল্যান্স পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরুর সময় তিনি পি কে হালদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। সে সময় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন হালদার।

পিএলএফএস’র চেয়ারম্যান হওয়ার আগে উজ্জ্বলকে ২০১৩ সালে নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে বসান পি কে হালদার।

২০১৬ সালে আইএলএফএসএল থেকে ৩৮ কোটি টাকা ঋণ নেয় নর্দান জুট। উজ্জ্বলের জবানবন্দি মতে, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে নেওয়া ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা হালদারের নাম-সর্বস্ব বর্ণ ও আরাবি এন্টারপ্রাইজের ঋণ হিসেবে শোধ করা হয়।

বাকি টাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় নর্দান জুটের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। পরে, সেই টাকা হালদার ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় বলেও জানান তিনি।

‘সেই ঋণ কখনোই শোধ করা হয়নি,’ বলেও জানান তিনি।

উজ্জ্বলের দাবি, ‘হালদার আমাকে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা বেতন দিতেন। আমি তখন বুঝতেও পারিনি যে ঋণ জালিয়াতির কাজে তিনি আমাকে ব্যবহার করবেন।’

গত ২৫ জানুয়ারি উজ্জ্বলকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পরদিন আইএলএফসিএল’র ৩৫০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হালদার ও উজ্জ্বলসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।

উজ্জ্বল বলেছেন, পিএলএফএস’র চেয়ারম্যান হওয়ার পরপরই তিনি হালদারের নির্দেশনা মোতাবেক নিয়মনীতি ভেঙে ঋণ দিতে শুরু করেন।

তাৎক্ষণিকভাবে তিনি হালদারের দুটি নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান— দিয়া শিপিং ও এমটিবি মেরিনকে ঋণ দিতে ভূমিকা রাখেন।

‘পরে, আমি জানতে পারি যে দিয়া শিপিং শুধুমাত্র কাগজে-কলমে রয়েছে এবং টাকাগুলো দিয়া বা এমটিবি মেরিনের অ্যাকাউন্টে যায়নি’, যোগ করেন উজ্জ্বল।

সেই টাকা হালদারের অপর নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান এফএএস ফিন্যান্সের ঋণ শোধ করতে ব্যবহার করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।

উজ্জ্বলের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বাধীন পিএলএফএস’র পরিচালনা পর্ষদ এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তারা সেই সময় প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক হিসাব তৈরি করে প্রায় ১১১ কোটি টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছিলেন।

‘অপকর্ম ঢাকার জন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, মহাব্যবস্থাপক ও অন্যান্যদের প্রতি বছর এক কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হতো। এ প্রক্রিয়া ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল’, যোগ করেন উজ্জ্বল।

তিনি আরও বলেন, ঘুষের মোট পরিমাণ সাড়ে ৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল।

মোয়াজ্জেম ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি ঘুষ নিইনি। আমি আমার ১৫ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু, আমি ছয় কোটি টাকা এখনো পাইনি। এ জন্যে আমি আইনি নোটিশও পাঠিয়েছি।’

সেই সময় দুর্নীতি ঢাকতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পিএলএফএসের সেই সময়কার এমডি, ডিএমডি ও সিএফও (চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার) এ বিষয়ে বলতে পারবেন। আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।’

মোয়াজ্জেমের দাবি, তিনি বিভিন্ন সংস্থাকে উজ্জ্বল ও হালদার সম্পর্কে তথ্য দেওয়ায় তারা তার প্রতি নাখোশ রয়েছেন। বলেন, ‘তারা আমার ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’

স্বীকারোক্তিতে উজ্জ্বল আরও জানান, ডিপার্টমেন্ট অব ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস অ্যান্ড মার্কেটস’র (ডিএফআইএম) তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।

হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে ডিএফআইএম ও ডিপার্টমেন্ট অব ব্যাংকিং ইন্সপেকশন-২’র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘উজ্জ্বল আমার সম্পর্কে তার স্বীকারোক্তিতে যা বলেছেন তা ভিত্তিহীন।’

তার দাবি, উজ্জ্বল নিজেকে রক্ষা করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন।

‘২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়ে উজ্জ্বল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু, আমি সেই বিভাগে যোগ দিই ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে’, যোগ করেন শাহ আলম।

তিনি আরও বলেন, একজন মহাব্যবস্থাপক একা এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এক্ষেত্রে সহকারী পরিচালক থেকে শুরু করে গভর্নর পর্যন্ত সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

8h ago