মতামত: আইন কঠোর করার পাশাপাশি, সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে যৌতুক গ্রহণকারীদের

ছোটবেলায় আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে একটি বাড়িতে বিয়ে হল। বিয়ের পর ঐ বাড়িতে এল নতুন বউ। আমরা ছোটরা সবাই গিয়েছিলাম বউ দেখতে। বউ আসার বেশ কয়েকমাস পর একদিন বউটি মারাও গেল। তখন শুনেছিলাম পরীর মত দেখতে ঐ বউটি নাকি বিষ খেয়েছে।

আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। মনে প্রশ্ন ছিল কেন এত সুন্দর একটি নতুন বউ নিজে বিষ খেলো। কিন্তু প্রশ্নের কোন উত্তর ছিলো না। শিশু ছিলাম বলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ভুলেও গিয়েছিলাম ঘটনাটি। এর অনেকদিন পর বুঝেছিলাম বউটির বাবা কথামত যৌতুক দিতে পারেনি বলে, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেয়েটিকে অত্যাচার করতো, তাই সেদিন মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। জানি না এর জন্য ওদের কোন বিচার হয়েছিল কিনা। ৪০ বছর আগে যৌতুক চাওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কোন আইন ছিলো না।

এরও অনেক পরে আমার এক পরিচিত পরিবারের একটি মেয়ের বিয়ে হল রংপুরে। শুনলাম যৌতুকের দাবিতে ওর শ্বশুর ওদের বাসরশয্যা পর্যন্ত হতে দিচ্ছেন না। কী ভয়াবহ অমানবিক আচরণ। যতদিন যৌতুক ঠিকমত আদায় হবে না, ততদিন উনি বাসরঘরও হতে দেবেন না। এই ঘটনায় মেয়েটির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবারে নেমে আসে চরম দুর্বিপাক। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটিও শোকে-দু:খে পাথর হয়ে পড়ে। এত অবমাননা সইতে না পেরে সেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। যাহোক পরে তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো গেছে। পরবর্তীতে সংসারটাও হয়েছিল বিভিন্নজনের মধ্যস্থতায়। সম্ভবত তখনও যৌতুক চাওয়া নিয়ে কোন আইন ছিলো না।

এখন যৌতুক নিরোধ আইনকে আরও কঠোরতর করা হয়েছে। তবে শুধু আইন কঠোর করাই নয় এর বাস্তবায়নও ঘটাতে হবে কঠিনভাবে। যৌতুক চেয়ে কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৭’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পরেই রূপগঞ্জে একজন গৃহবধূকে যৌতুকের জন্য মারধর করে জুতার মালা পরিয়ে চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব মারধরের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে নির্যাতিত গৃহবধূ সালমা আক্তার সুমির দেবর। এটি শুধু একটি ঘটনা, এরকম হাজার হাজার নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে আমাদের চারপাশে।

অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে যায়। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন সম্পর্ক সব মিলে একদম অচেনা-অজানা একটি সংসারে পা রাখে নতুন বউ। যেমন রেখেছিল সুমি। মাত্র ছয় মাস আগে সে বউ হয়ে এসেছে এই বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকেই মাত্র এক লাখ টাকা যৌতুকের জন্য চলছে তার উপর নির্যাতন। শেষপর্যন্ত জুতার মালা এবং সেই দৃশ্য ভিডিও করা। ব্যাপারটা ভাবলেও লজ্জায়, ক্ষোভে, দু:খে মাথা নত হয়ে আসে। নারীর কী ভয়াবহ অমর্যাদা। ঠিক এরকম একটা পরিস্থিতিতে সুমি নামের ওই বউটি যদি তার অপমান মুছতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তাহলে আইনের আওতায় ওই পরিবারের প্রতিটি অত্যাচারী সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসে, তখন তার মনে যে ভয়টা থাকে সেটা হচ্ছে এই যৌতুকের ভয়। কী জানি কী শুনতে হবে তাকে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে। কতটা নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে তাকে, শুধু সেটাই ভাবতে থাকে। প্রায় সব শ্বশুরবাড়িরই কিছু দাবি-দাওয়া থাকে। ঘড়ি, সোনাদানা, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে নগদ টাকা, বাড়ি, গাড়ি, আসবাবপত্র, চাকরি সবই এই যৌতুকের আওতায়। ছেলের বাড়ি থেকে যখন মেয়েকে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য জোর-জবরদস্তি করা হয়, তখন সেটাও একধরণের যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে। বিয়ের সময় মেয়ের অভিভাবককে ত্রস্ত থাকতে হয় পাত্রপক্ষ কখন কী দাবি করে বসে এই ভেবে।

আমাদের দেশে বড়লোক ও সচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সাধ্যমত মেয়েকে বাড়ি, গাড়ি, জমি, হীরা, পান্না সবই দেয়। শুনেছি কোন কোন এলাকায় মেয়েকে ঘটি-বাটি, লুছনি মানে রান্নাঘরের ডেকচি ধরার কাপড় পর্যন্ত দেয়া হয় যেন নতুন সংসারে মেয়ের কোন কষ্ট না হয়, যেন কোনকিছু কিনতে না হয়। জগতের সব মা-বাবা আসলে এমনই হয়। তারা প্রাণ থাকতে মেয়ের কোন ক্ষতি হতে দেয় না। কিন্তু যখন তাদের সামর্থ্য থাকে না কোন কিছু দেওয়ার বা ভাল কিছু দেওয়ার তখন তারা খুব অসহায় বোধ করেন। যদি পাত্রপক্ষ যৌতুকের জন্য মেয়ের অভিভাবকের উপর চাপ দেয়, তখন তারা যেভাবে পারেন টাকা যোগাড় করার চেষ্টা করেন। মানুষের কাছে চেয়ে, ব্যক্তিগতভাবে বা ব্যাংক থেকে ঋণ করে, জমিজমা ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে যৌতুকের টাকা যোগাড় করেন।

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে ধনীরা খুব শখ করে মেয়েকে সাজিয়ে দেন। জামাইকে এটা-সেটা দেন। আশেপাশে যারা এটা দেখেন বা শুনেন তারাও তখন মনে করেন ওরা দিতে পারলে আমাদের ছেলেকে কেন দেবে না তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। তারা তখন পাত্রীপক্ষের উপর চাপ দিতে শুরু করেন। আর এটাই কালক্রমে যৌতুকের রূপ ধরে। যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয়ার পর কোন মেয়ে সুখী হতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই। কারণ পাত্রপক্ষের এটি একটি চলমান দাবি। ইতর শ্রেণির পাত্রপক্ষ এটা চাইতেই থাকে।

যৌতুকের জন্য বউয়ের উপর নির্যাতনের ঘটনা এদেশে নতুন কিছু নয়। শুধু নির্যাতন নয়, নির্যাতন করতে করতে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। এ জন্য ১৯৮০ সালে করা হয়েছিল যৌতুক নিরোধ আইন। এই আইনে যৌতুক চাইলে ও লেনদেন করলে শাস্তির বিধান থাকলেও যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য শাস্তির কথা বলা নেই। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে বা যতটুকু অপরাধ করছে, তার চেয়ে হালকা শাস্তি পাচ্ছে। তাই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনকারীর শাস্তির বিধান, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত খসড়ায় যৌতুক চেয়ে নির্যাতনের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিধানে আরও বলা হয়েছে কেউ যদি এই আইনের অপপ্রয়োগ করে, তাহলে তাকেও সাজা ভোগ করতে হবে।

যৌতুকের কারণে ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ২০৩ জন নারীকে। নির্যাতিত হয়েছে ১৮৩ জন। ওই বছরই যে ৩৩৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছে, এরমধ্যে যৌতুকের বলিও আছে। ২০১৬ এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির হিসাব অনুযায়ী যৌতুকের জন্য হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৬ জন। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে। এগুলোর হিসাব আছে কাগজে-কলমে। হিসাবের বাইরে আছে আরও অনেক ঘটনা, যারা মামলা করে না, আইনের কাছে যায় না, সমাজের কাছে বিচার দেয় না। দৈনিক প্রথম আলো ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে তারা ২০টি আত্মহত্যার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখেছে যে মূলত কী কী কারণে নারীরা আত্মহত্যা করেন। এরমধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌতুক।

আমাদের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে যৌতুক নেয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুক না দিতে পারলে কন্যাকে, কন্যার পরিবারকে অত্যাচার করাটাও রেওয়াজ হয়ে গেছে। আমরা সামাজিকভাবে একে প্রতিরোধ করি না। বয়কট করি না যৌতুক নেয়া পরিবার ও মানুষকে। আর তাই কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধীদের হাত লম্বা হচ্ছে। আইন কঠোর করার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নও কঠোর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিকভাবে বয়কট করতেই হবে যৌতুক নেয়া পরিবার ও সেই পরিবারের অসভ্য ছেলে সন্তানটিকে। মেয়েদেরও শেখাতে হবে যৌতুক দিয়ে বিয়েতে রাজি হওয়াটা শুধু তার জন্য অবমাননাকরই নয়, এটা একটা অপরাধও বটে।

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

8h ago