নবজাতক যখন মায়ের কোল থেকে চোরের কোলে
ঘটনার সময়টা ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাস। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন মা তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ভোরবেলা। সেদিনই গভীর রাতে কেবিনে থাকা আরেকজন সন্তানসম্ভবা মায়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় ওই সদ্য প্রসূতি মায়ের। উনি দেখলেন একজন বহিরাগত নারী তার বাচ্চাটিকে খাট থেকে কোলে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার বাচ্চার আয়া, যাকে হাসপাতালে এসে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল প্রসূতিকে সাহায্য করার জন্য। নবজাতকের মা ঘুম জড়ানো চোখে উঠে দাঁড়ালেন এবং বাচ্চাটিকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কী, তুমি কে? তুমিতো আমার বাচ্চার আয়া নও, তাহলে এত রাতে আমাদের কেবিনে ঢুকে বাচ্চাকে কেন কোলে নিয়েছো? আয়াটি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। বলেছে, “ভুল কইরা ঢুইকা পড়ছিলাম আফা। মাফ কইরা দ্যান।” বাকি রাতটুকু মা আর বাচ্চাটিকে কোল ছাড়া করেননি, ঘুমাতেও পারেননি।
পরদিন এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আয়াদের একটা বড় দল এসে ঐ মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। উনি এসব ক্ষমাটমার ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে হাসপাতালে অভিযোগ দায়ের করে সকাল হওয়ার সাথে সাথে বাচ্চা নিয়ে চলে আসেন বাসায়। পরে শিশুটির বাবা জানতে পেরেছিলেন ওই নারী একটি সংঘবদ্ধ দলের সদস্য, যারা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি করে সন্তানহীন বাবা মা অথবা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই আয়াটির কাজটি চলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের দলের বাচ্চা চুরির কাজ যে আজো অব্যাহত রয়েছে, তাতো দেখতেই পাচ্ছি। এই ফাঁকে বলে রাখি, চুরি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ওই ভাগ্যবান বাচ্চাটি হচ্ছি আমি।
এই ঘটনার ৩০ বছর পর, আমি যখন মা হলাম, তখন আমার সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিলো, সন্তান চুরি বা হারিয়ে যাওয়ার ভয়। আমি সবাইকে বহুবার এই প্রসঙ্গে সাবধান করেছিলাম। বাচ্চা হওয়ার পর আমি যখন বাচ্চার কাছে থাকবনা, তখন কেউ যেন আমার বাচ্চাকে কাছ ছাড়া না করে। যদিও সেটা ছিল একটি বেসরকারি ক্লিনিক, তাও সাবধান থাকতে হবে সবাইকে। পরে আমি বহুবার ভেবেছি ইস যদি সত্যি সেদিন আমাকে ওরা চুরি করতো, তাহলে আমি আজ কোথায়, কীভাবে, কোন পরিবেশে বড় হতাম কে জানে। ওই ভয়টা যে আমার অবচেতন মনে তাড়া করতো, তা স্পষ্ট বুঝেছিলাম আমার বাচ্চা হওয়ার সময়। সেদিনই প্রথম প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করলাম আমার মায়ের অনুভূতি। সে সময় যদি তার নবজাতক হারিয়ে যেত তাহলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতো আমার মা। ১০ মাস গর্ভে ধারণ করে, সন্তান জন্ম দিয়ে, দুধ খাওয়ানোর পর যখন সেই বুকের মানিক হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তখন মায়ের পাগল হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা।
যেমনটি পাগল হয়েছিলেন মুক্তি খাতুন। ১৯ জানুয়ারি প্রসবের ছয় ঘণ্টার মধ্যে তিনি হারিয়ে ফেলেন তার কোলের মানিককে। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া মাতৃসদনেই পড়ে ছিলেন ২৭ তারিখ পর্যন্ত। কারণ তিনি তার সন্তানকে না নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন না। উনি ভাগ্যবতী। শেষপর্যন্ত পুলিশ তার সন্তানকে উদ্ধার করে দিতে পেরেছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে চোর। এখানেও দেখা গেল নবজাতক চুরির ঘটনার সাথে জড়িত ওই মাতৃসদনের মাঠকর্মী। যিনি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এই নারীকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল।
আল জাজিরা টেলিভিশনের ২০১৪ করা একটি রিপোর্ট অনুযায়ী মোট ১৬ টি শিশুকে চুরি করা হয়েছিল সে বছর এবং এরমধ্যে পাঁচ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১৩ সালে চুরির এই সংখ্যা ছিল অর্ধেক। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের বরাত দিয়ে তারা এই তথ্য দিয়েছিল। ফোরাম মনে করে চুরির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি কারণ “অধিকাংশ নবজাতকই গ্রামীণ এলাকার হাসপাতালগুলো থেকে চুরি গেছে, যা রিপোর্টে আসেনি।” তারা আরও মনে করে যে সন্তানহীন মা-বাবার কাছে একটি বাচ্চার চাহিদা, নবজাতক চুরি বাণিজ্য বাড়ার মূল কারণ। চুরি হয়ে যাওয়া প্রতিটি বাচ্চাকে প্রায় ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। যেসব ঘটনা রিপোর্ট হয়ে আসে বা মামলা হয়, আমরা শুধু সেসবই জানতে পারি।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অপরাধীদেরও একজন স্বীকার করেছে যে, দরিদ্র বাবা মাকে ক্লিনিকে নিয়ে এসে বাচ্চা প্রসবের পর অপরাধী চক্রের কোন একজন সদস্য তাদের জানায় যে তাদের বাচ্চাটি মৃত হয়েছে। পরে তারা সেই সুন্দর, স্বাস্থ্যবান বাচ্চাটিকে সন্তানহীন মা-বাবার কাছে বিক্রি করে দেয়।
এদিকে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের পার্ট-টাইম আয়দের অনেকেই ও বাইরের হাসপাতালে ধাত্রীদের অনেকেই শিশু চুরির সাথে জড়িত। এরা সবাই নবজাতক চুরির সংঘবদ্ধ দলের সক্রিয় সদস্য। র্যাব ও পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, এই দলের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবাই আছে, সবাই নানাভাবে জড়িত। যে বা যারা এইসব দলের নেতা তাদের সাথে বেশ ভালো যোগাযোগ থাকে দালাল ও আনসার বাহিনীর কারো কারো সাথে। যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত, তারা অনেকদিন ধরে এই নবজাতক চুরি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। এটি একটি লাভজনক ও চলমান ব্যবসা। পুলিশ জানিয়েছে চোরেরা নাকি বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে। তারা ছেলে নবজাতককে বলে ‘বর’ আর মেয়ে নবজাতককে বলে ‘বউ’। মেয়ে নবজাতক বিক্রি হয় ৫০ হাজার টাকার উপরে। আর ছেলে শিশু বিক্রি হয় প্রায় এক লাখ টাকায়। তাদের বেশি দৃষ্টি থাকে ছেলে বাচ্চার উপরে। কারণ বাংলাদেশের মত পুরুষতান্ত্রিক ও সনাতনী ধ্যানধারণা প্রসূত, জেন্ডার অনিরপেক্ষ সমাজে ছেলে সন্তানের চাহিদা সবার কাছেই বেশি। সেজন্য ছেলে বাচ্চার দামও বেশি।
নবজাতক চোরেরা চোখ রাখে প্রসূতির উপর, কার বাচ্চা কখন হচ্ছে, এদের দেখাশোনার জন্য কারা কারা আছে, প্রসূতি কী ধরণের পরিবার থেকে এসেছে, সদ্যজাত বাচ্চাটির স্বাস্থ্য কেমন ইত্যাদি বিষয়ে। আর তাই এই চোরদের দলে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের লোক জড়িত থাকে। কেউ প্রসূতির ওপর চোখ রাখে, কেউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর চোখ রাখে, কেউ তথ্য দেয়, কেউ বাচ্চাটিকে চুরি করে, কেউ বাচ্চাটিকে হাসপাতালের বাইরে পাচার করে দেয়, আর কেউ বাচ্চাটিকে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়। প্রত্যেকের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া থাকে। বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক মানুষের আনাগোনা থাকে। সেখানে জবাবদিহিতাও ততটা শক্ত নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ দুর্বল। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায় নবজাতক চোরেরা।
শিশু চুরির হার সরকারি হাসপাতালে বেশি বলে অনেক সরকারি হাসপাতালই তাদের নজরদারি বাড়িয়েছে। যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং ওয়ার্ড ইনচার্জ ও অন্যান্য স্টাফদের জবাবদিহিতা বাড়ানোর মাধ্যমে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ধরনের নজরদারি আরও অনেক বাড়াতে হবে। সেইসাথে প্রসূতি মা ও মায়ের সাথে থাকা মানুষদের সচেতন ও সাবধান করে দিতে হবে নবজাতক চোরদের সম্পর্কে। কারণ সাধারণ মানুষের মনে নবজাতক চুরি সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা না থাকারই কথা। বাচ্চা হওয়ার আনন্দে মানুষ এতটাই অধীর থাকে যে আশপাশের কিছু খেয়ালই করে না। সবচেয়ে বড় কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন কাউকে ফুল-টাইম বা পার্ট-টাইম যে চাকরিই দিক না কেন, তা যথাযথভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, দারিদ্র ইত্যাদি নানা ইস্যুতে এত বড় বড় সব সমস্যা আছে যে ব্যক্তি মানুষের একক সমস্যাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেয়াটা কঠিন। কিন্তু তারপরও যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অপরাধ আরও গুরুত্ব দিয়ে ও শক্ত হাতে দমন করা উচিত। কারণ মায়ের বুক থেকে তার সন্তান হারিয়ে গেলে শুধু সেই মা-ই বুঝতে পারেন কি যন্ত্রণা বুকে চেপে উনি বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। তার দু’চোখ শুধু খুঁজে ফেরে ছোট্ট একটি নরম তুলতুলে শরীর, যে ছিল তার মায়ের বুকের ধন।
Comments