বসন্তের সাঁঝে নিভলো সন্ধ্যা বাতি
হেমন্তের সন্ধ্যায় নয়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন বসন্তের সন্ধ্যায়। কার্তিকের হিম জোছনার আগ মুহূর্তে সাঁঝবেলায় জন্ম বলে নাম রাখা হয়েছিল সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যা প্রদীপ নিভে গেল রাতের আঁধারে। বাংলা গানের সঙ্গে এতোখানি আপন সত্ত্বা বিলিয়ে দিতে পারেননি বোধহয় আর কেউ। এতোটা দীর্ঘসময়, এতোটা অবিস্মরণীয় পথ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দের পর শেষ ছিলেন কেবল সন্ধ্যা। চির অভিমানী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এক সোনালি প্রজন্মের অন্ত হলো।
জন্মেছিলেন রেল কর্মকর্তা বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও হেমপ্রভা দেবীর ঘরে কার্তিকের হিম সন্ধ্যায়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলে স্নেহের ভাগ পুরোটা জুড়েই ছিলেন তিনি। মাত্র ৬ বছর বয়সে বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখার মধ্য দিয়েই সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। মা হেমপ্রভা দেবী দারুণ গাইতেন নিধু বাবুর টপ্পা। না শিখেও যে এতো দরদমাখা কণ্ঠে গাওয়া যায় তা আজীবন অবাকই করেছিল সন্ধ্যাকে। কিন্তু, সন্ধ্যার সংগীতের আসল কাণ্ডারি ছিলেন দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনিই মূলত সন্ধ্যাকে প্রাতিষ্ঠানিক সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন।
তাদের পরিবারের সঙ্গেই মিশেছিল সুরের বাঁধন। এক সাক্ষাৎকারে সন্ধ্যা নিজেও বলেছিলেন, 'সংগীতের ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের বংশপরম্পরায়। আমাদের বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় একজন বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তার ছেলে সারদাপ্রসাদও নিয়মিত গান-বাজনার চর্চা করতেন। সারদাপ্রসাদের ছেলেই আমার ঠাকুরদা। এরা প্রত্যেকেই উচ্চাঙ্গসংগীত নিয়ে চর্চা করতেন।'
তৎকালীন সময়ে গান শেখানোর বিষয়ে কিছুটা গাত্রবর্ণকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। সন্ধ্যা নিজেই লিখেছেন, 'যেসব মেয়ের রঙ ময়লা হত, গান জানলে তাদের বিয়ে হবে এই আশায় বাড়ির লোক তাদের গান শেখাতেন। আমার ক্ষেত্রেও খানিকটা তাই। আমার গায়ের রঙ কালো হয়তো সেজন্যই আমার গান শেখার ব্যাপারে দাদাদের সায় ছিল।'
১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে বসেছিল অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের আসর। সন্ধ্যার নাম তুলে দিয়েছিলেন তার বড়দাই। সেবারের আসরে একমাত্র রবীন্দ্রসংগীত বাদে সব ক্যাটাগরিতেই প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। সর্বসেরা হয়ে ট্রফি নিতে মঞ্চে যখন উঠবেন সন্ধ্যা হালকা পাতলা সন্ধ্যাকে দেখে ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবী বলেই ফেললেন, 'এতোটুকু মেয়ে এতো বড় শিল্ড ধরবে কীভাবে?' প্রথম হওয়ায় সুযোগ পেয়েছিলেন রেডিও আকাশবাণীতে গাওয়ার। রেডিওতে 'গল্পদাদুর আসর' এ অজয় ভট্টাচার্যের লেখা গান গেয়ে প্রথম পারিশ্রমিক হিসেবে সন্ধ্যা পেয়েছিলেন প্রথম উপার্জিত ৫ টাকা পারিশ্রমিক।
১৯৪৬ সালের 'গীতশ্রী' পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। ভজন ও গীতশ্রী দু'টো পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় সন্ধ্যার প্রথম রেকর্ড বের হলো এইচএমভি থেকে। রেকর্ডের একপাশে ছিল গান 'তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো', অন্যপাশে ছিল 'তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে'। এই খবর কানে গিয়েছিল কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়ালের। রাইচাঁদ বড়াল বললেন, 'এতোটুকু মেয়ে গতবার এতোগুলো প্রাইজ নিয়ে গেল, এবার গীতশ্রীতে প্রথম হলো! তাকে দেখাও তো একদিন।' সন্ধ্যার বড়দা রবীন্দ্রনাথের কানে যেতে তিনি নিজেই সন্ধ্যাকে নিয়ে হাজির হলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। সেখানে ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, আলী হোসেন খাঁ'রাও। সন্ধ্যার গাওয়া ঠুমরি, ভজন, খেয়ালের দারুণ প্রশংসা করেছিলেন উপস্থিত সবাই। সহজে কারো প্রশংসা না করা রাইচাঁদ বড়াল বললেন, 'আরে এতো সোনার মেয়ে! আর অপেক্ষা ঠিক নয়!' কাগজ এগিয়ে বললেন, 'স্বাক্ষর করো। নেক্সট সিনেমাতে তুমিই করবে প্লেব্যাক।' চলচ্চিত্রের নাম ছিল 'অঞ্জনগড়'। পরিচালক ছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার বিমল রায়।
অঞ্জনগড় চলচ্চিত্রে ষোড়শী সন্ধ্যার নিখাদ গলাই লুফে নিলো সবাই। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র 'সমাপিকা'য় তাকে বাছাই করলেন সংগীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী ছিলেন সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্লেব্যাকের রেকর্ড যেদিন হবে সেদিন সন্ধ্যাকে দেখে তিনি ভীষণ অবাক। রবীন চট্টোপাধ্যায়কে বলেই ফেললেন, 'এ তোমরা কি করছ? চৌদ্দ পনের বছরের একটা ইমম্যাচিউর মেয়েকে দিয়ে আমার লিপে গান গাওয়াচ্ছো। আমার গলায় মিলবে কেন?' রবীন চট্টোপাধ্যায় বললেন, 'আগে শুনে দেখোইনা। তারপর বলবে।' সন্ধ্যার গান শুনেই থ হয়ে গেলে সুনন্দা! এই মেয়ে এই গান গেয়েছে! এই দুটো চলচ্চিত্রে নেপথ্যে গায়িকা হিসেবে যাত্রার পর আর পিছু তাকাতে হয়নি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক গুরু ছিলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তার কাছে কয়েকবছর তালিম নেওয়ার পর পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসুর কাছে গান শিখেছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পরে সন্ধ্যা তার বড়দার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করে বলেছিলেন, যদি ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের কাছে গান শিখতে পারতাম। সেই ইচ্ছেও অপূর্ণ রাখেননি বড়দা। তখন কলকাতা এলে বড়ে গুলাম আলী খাঁ উঠতেন সঙ্গীতজ্ঞ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিকসন রোডের বাড়িতে। সেখানেই আসত আগ্রহীরা। সন্ধ্যার আবদার রাখতে বড়দা গিয়েছিলেন সেই বাড়িতে। ক'দিন পরে খবর এলো সন্ধ্যাকে খাঁ সাহেব শিষ্য করতে সম্মত হয়েছেন।
১৯৪৯ সালের পৌষের একদিন কলকাতায় এলেন বড়ে গুলাম আলী। খবর পাওয়া মাত্রই সন্ধ্যা ছুটলেন ডিকসন রোডের দিকে। দুরুদুরু বুক। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী তখন সুরমণ্ডল বাজাচ্ছেন। সেই প্রথম উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তিকে দর্শন সন্ধ্যার। সন্ধ্যা বসলেন, খাঁ সাহেব তার মুখে তুলে দিলেন ছোলা আর গুড়, একইসঙ্গে মোটা লাল সুতা বেঁধে দিলেন সন্ধ্যার কবজিতে। প্রথাগতভাবেই ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীতে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ মারা গেলে তিনি শিষ্য হয়েছিলেন তারই ছেলে ওস্তাদ মুনাওয়ার আলী খাঁয়ের কাছে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুর কথা। 'বিদুষী ভার্যা' চলচ্চিত্রের জন্য রেকর্ডিং শেষে একদিন বাড়ি ফিরছেন সন্ধ্যা। গলির মোড়ে আসতেই একজন বলল, 'শচীনকর্তা তোমাকে বোম্বে নিয়ে যেতে চান গো। শচীনদার বউ বউদি তোমার গান শুনতে চেয়েছেন।' শুনেই আপ্লুত হলেন সন্ধ্যা। পরদিন সকালবেলাতেই হাজির হলেন সাউথ পার্কের বাড়িতে। সন্ধ্যার গান শুনেই মীরা দেববর্মণ বলেই ফেললেন, 'কি মিষ্টি গলা গো তোমার!' এরপর শচীন দেববর্মণের সঙ্গেই সন্ধ্যার বোম্বে যাত্রা।
হিন্দি চলচ্চিত্রে অবশ্য তার অভিষেক শচীন দেববর্মণের হাত ধরে নয়। বরং অনিল বিশ্বাসের সুরে। মূলত সন্ধ্যার বড়দাই অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। অনিল বিশ্বাস প্রায়ই যেতেন সন্ধ্যাদের বাড়িতে। অনিল বিশ্বাসের সুরে 'তারানা' চলচ্চিত্রে গাইতে গিয়ে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় হয় সন্ধ্যার। 'বোল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল' গানটি ছিল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তার দ্বৈত কণ্ঠে। লতার গাওয়া গানে মধুবালার লিপসিন, সন্ধ্যার গাওয়া গানে লিপ সিন মেলাবে শ্যামা। প্রথম পরিচয়ের পর কয়েকদিনের দিনের মধ্যেই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিবাস এভারগ্রিন হোটেলে প্রায়ই আড্ডা জমতো এই দুই শিল্পীর।
দুই বছরে মোট ১৭টি হিন্দিভাষী চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছিলেন সন্ধ্যা। কিন্তু, হিন্দি ফিল্মজগত ছেড়ে তিনি স্বেচ্ছায় চলে এসেছিলেন তার প্রিয় কলকাতায়। কলকাতায় ফিরে এরপর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যা করলেন তাকে এককথায় বলা যায় বিপ্লব। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ডুয়েট ছাড়া যেন বাংলা চলচ্চিত্র হয়ে পড়েছিলো অকল্পনীয়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মানেই যেমন লিপসিনে উত্তম কুমার ঠিক তেমনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানে লিপসিনে সুচিত্রা সেন।
সন্ধ্যার বিয়ে হয়েছিলো প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে। বেশ কয়েকবছর প্রেমের পর গুপ্ত পরিবার থেকে যখন সন্ধ্যার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব গেল, বাঁক কেটে বসেছিলেন সন্ধ্যার পরিবার। মুখার্জি পরিবারের মেয়ে গুপ্ত পরিবারে যাবে এটি নাকি একদমই মানতে পারেননি সন্ধ্যার বাড়ির কেউই। ফলে বহুদিন দু'জনের অপেক্ষা করতে হয়েছিল একে অন্যের জন্য। তাদের সেই প্রেম জন্ম দিয়েছিলো অসাধারণ কিছু গানের। ঠিক এসময়ে শ্যামল গুপ্তের কলমে রচিত হয়েছিল 'আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি', 'জনমে হয় যেন গো তোমায় ফিরে পাওয়া'র মতো গান। শেষপর্যন্ত অবশ্য দু'জনের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল সন্ধ্যার পরিবার। বিয়ের পরপরই শ্যামল গুপ্ত বলেছিলেন, 'তুমি যতো বড় শিল্পীই হওনা কেন, আমায় বিয়ে করে তোমায় কিন্তু থাকতে হবে আমার ছোট্ট একতলা বাড়িতেই।' সেই বাড়িতেই দীর্ঘদিন থেকেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অনেক গানই ছিল শ্যামল গুপ্তের লেখা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও এক অবিস্মরণীয় নাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তার গান বারবার অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। কেবল তাই নয় মুক্তিযুদ্ধের সময় অসহায় উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন গণআন্দোলনে। গান গেয়ে সংগ্রহ করেছিলেন ফাণ্ড। কেবল তাই নয় তিনি নিজেই তার আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে দিয়েছিলেন বড় অংকের অনুদানও। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আকাশবাণীতে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অজস্র দেশাত্মবোধক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত অপারেশন জ্যাকপটে প্রথম সংকেত ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।' বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সন্ধ্যা গেয়েছিলেন 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে'। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ দিবসে পল্টন ময়দানের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
বাংলা গান আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এক হরিহর আত্মা। যে বাংলাকে তিনি নিজের সর্বস্ব মন উজাড় করে দিয়েছেন, তার বিপরীতে বাংলাও তাকে দিয়েছে অপার ভালোবাসা আর মমতামাখা দরদ। আর তাইতো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি 'বাংলার মানুষের ভালবাসার চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমি আর কোথাও পাইনি।' সেই ভালোবাসাই বাংলা অনন্তকাল আপন হৃদয়ে ধারণ করে রাখবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে।
সূত্র: গানে মোর কোন ইন্দ্ৰধনু/ গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার/ সুমন গুপ্ত
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments