স্মৃতিতে কবরী: নায়িকা ‘সাহসিকা’র আখ্যান
সেই যে মেয়েটি খুব অল্প বয়সেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমালেন সিনেমায় অভিনয় করবেন বলে, তিনি মিনা পাল। অভিনয় শিল্পী হবার আকাঙ্ক্ষা তার ছিল না। তবে নৃত্যশিল্পী হবার বাসনা ছিল। তবে ভাগ্য বা কিছুটা দারিদ্র তাকে এনে হাজির করল অভিনয়ের দোরগোড়ায়। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার থেকে এফডিসিতে এসে হৃদয় হরণ করলেন মানুষের। এমনি এমনি কি মন কাড়া যায় অজস্র, লক্ষ-কোটি মানুষের? হারাতে হয় না কি কিছুই?
মেয়েটি তার শৈশব বাজি রেখেছিলেন। জিতেছিলেন হাজার মানুষের হৃদয়। বিপরীতে হারিয়েছিলেন শৈশব। আর খুঁজে পাননি একটিও মনের মতো বন্ধু। তবে এই পাওয়া আর হারানোর খেলা শুরু হয় ১৯৬৩ সালে, যখন তিনি ১৩ বছর বয়সে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। ঠিক দুধের দাঁত না পড়লেও আইয়ুব খানের নাম যেমন আমাদের শিখে নিতে হয়েছিলো সেই জমানায়, তেমনিই ছোট্ট মেয়েটির দুটি দাঁত তখনও পড়ে যায়নি। সেগুলো পোকায় ধরা ছিল। ঢাকায় এসে প্রথম টুথপেস্ট আর বক্ষবন্ধনীর ব্যবহার শিখেছিলেন। প্রথম ছবির শুটিংয়ে প্রথম দিনেই পরিচালকের হাতে চড় খেয়েছিলেন। পরে শুটিংয়ের মাঝেই পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন ফিরিঙ্গিপাড়ার বাড়িতে। ফিরেও আসতে হয়েছিল। সেই ছবির শুটিংয়ের মাঝেই মা হতে হয়েছিল তাকে। হয়েছিলেন চলচ্চিত্রটির প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী।
প্রথম ছবি সুতরাং (১৯৬৪) মেয়েটিকে ফ্রাংকফুটের সম্মাননা এনে দিয়েছিল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমার তকমা জুটেছিল সুতরাং'র কপালে। প্রায় এক লাখ টাকা লগ্নির বিপরীতে সুতরাং আয় করেছিল ১০ লাখ টাকা। আর তার পাশাপাশি মেয়েটি প্রবল একা হচ্ছিলেন এই বিশাল শহরে। এই যে মৃত্যুর আগেও মেয়েটি বারবার বলে গিয়েছিলেন, 'আমি বন্ধুহীন, আমি একা', এই যাত্রার সূত্রপাত তার প্রথম চলচ্চিত্রের হাত ধরেই। সুতরাং ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েটির কেবল প্রথম চলচ্চিত্রই ছিল না, বরং তার জীবনের বাঁক বদলের বয়ান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই ছবির পরতে পরতে। এটা তার প্রথম ছবি, প্রথম ব্যবসাসফল ছবি, কুমারী থেকে মা হবার যাত্রার বয়ান।
তবে ফিরিঙ্গিবাজারের মিনা পালের যাত্রা এখানেই থেমে থাকবে না। সময়ের সাথে এই মিনাই হয়ে উঠবেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম অভিনয়শিল্পী। দেশি চলচ্চিত্রে ছয় দশকের যাত্রাপথে, মেয়েটি হাঁটবেন মাথা উঁচু করে। সেই যে ১৪ বছর বয়সের ছোট্ট কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন উর্দু সিনেমা থেকে বাংলার দর্শকের চোখ ফেরাবার দায়। তারই পরম্পরা জারি রাখবেন আমৃত্যু। আর স্বাক্ষী হয়ে থাকবেন বাংলা চলচ্চিত্রের বাকবদলের সংগ্রামী ইতিহাসের। হয়ে উঠবেন কিংবদন্তী, হয়ে উঠবেন কবরী।
এই যে অনন্য কবরী, তিনি শুধুমাত্র অভিনয় শিল্পী হয়েই জীবন কাটিয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। অভিনয় জীবনের কয়েক বছরের মাথায় তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রযোজক হিসেবে। শীত-বসন্ত (১৯৬৮) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্রযোজনায় সূত্রপাত হয়েছিল তার। প্রথমে প্রডাকশন হাউজের নাম শ্রীমতি রাখলেও পরবর্তীতে নাম পাল্টে রাখতে হয় কবরী প্রডাকশন। গুন্ডা (১৯৭৬) ছিল কবরী প্রযোজিত শেষ ও ব্যাবসা সফল চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি। আলমগীর কুমকুম পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটিকে একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে ১৯৭৩ সালে রাজ্জাক প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র রংবাজ এর সিক্যুয়েল হিসেবে মনে হতে থাকে। মজার বিষয় হলো, রংবাজ (১৯৭৩) এ কবরী অভিনীত চিনি চরিত্রটির থেকে গুন্ডাতে বিথী চরিত্রটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হিসেবে হাজির হয়। অর্থাৎ চিনি যা যা পারেনি রংবাজ এ, বিথী তার সবগুলোই করে দেখিয়েছে গুন্ডায়। দু'টো চলচ্চিত্রেই কিন্তু অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক ও কবরী। এই জুটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। একত্রে তারা প্রায় ৪১ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই জুটির রসায়ন নিয়ে যেমন কথাবার্তা রয়েছে, তেমনি তাদের মধ্যে টেনশনও বেরিয়ে এসেছে পত্রপত্রিকায়; ওনাদের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষ্যাৎকার ও কবরীর আত্নজীবনী স্মৃতিটুকু থাক (২০১৭) এ। তারই পরম্পরা এই দুই তারকা প্রযোজিত দু'টো চলচ্চিত্রেও দেখতে পাই।
মুক্তিযুদ্ধের আগের এবং পরের দশকজুড়ে কবরী বাংলা চলচ্চিত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। যদিও ষাটের দশকে শবনম এবং কবরী দু'জনেই প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, তবে শবনম উর্দু সিনেমার দিকে ঝুঁকে গেলে কবরীর এই আধিপত্য জারি থাকে পরবর্তী দশক পর্যন্ত। তবে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র উর্দু ভাষায় নির্মিত বাহানার (১৯৬৫) নায়িকা কিন্তু কবরীই ছিলেন। জহির রায়হান নির্মিত চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের চোখে উৎরে গেলেও তেমন ব্যবসাসফল হলো না। তবে বাংলায় কবরী জোয়ার নিয়ে আসলেন। এসময়ের অরুণ বরুণ কিরণ মালা (১৯৬৮) বা সাত ভাই চম্পার (১৯৬৮) মতো ফোক-ফ্যান্টাসি, আবির্ভাব'র (১৯৬৮) মত সামাজিক, কত যে মিনতি (১৯৭০), নীল আকাশের নীচে'র (১৯৬৯) মত রোমান্টিকসহ সব জনরার ছবিতেই কবরী হয়ে উঠলেন অনন্য। নিজেকে ভেঙে প্রতিটি চলচ্চিত্রে নতুন ছাঁচে ফেলছেন। আর দর্শক ব্ল্যাকে হলেও টিকেট কেটে কবরীকে দেখতে আসছেন। তার মিষ্টি হাসির আবেদন, চেহারার সরলতা আর এর পেছনের প্রবল পরিশ্রম কবরীকে এসময় অপ্রতিদ্বন্দী সম্রাজ্ঞীতে পরিণত করল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হিসেবে ভারতে পাড়ি জমানোর দুর্বিষহ বয়ান বিবৃত করেছিলেন তার আত্নজীবনীতে। তবে ভারতেও থেমে থাকেননি তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যে। মৃত্যু, স্বজন হারানোর বেদনা, শরণার্থী জীবন, অনিশ্চয়তার মাঝে কাটানো সেই সময়ের কথা আমৃত্যু স্মরণ করেছেন। যুদ্ধকালীন জয় বাংলা (১৯৭১) মতান্তরে জয় বাংলাদেশ নামের এক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। আর সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক শরণার্থী জীবনের অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করে বিনা দ্বিধায় দান করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। কবরী বরাবর এমনই ছিলেন। ভালোবাসলে যেকোনো কিছু দিয়ে দিতে পারতেন অকাতরে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই দেশে ফিরে কবরী ফের ডুব দিলেন কাজে। ঋত্ত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করলেন তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে। মজার বিষয়, এই সিনেমায় কবরী অভিনীত রাজার ঝি চরিত্রটির থেকে রোজি অভিনীত বাসন্তী চরিত্রটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ দেখায়। অথচ সে সময়ের ব্যস্ততম নায়িকা এবং তারকা হয়েও সেই স্টারডম থেকে বেরিয়ে এসে কাজ করতে তার এতটুকু বাধে নি। শুধু এটাই নয়, একে একে ৭ জন নতুন নায়কের নায়িকা হয়েছিলেন তিনি। সুভাষ দত্ত'র সঙ্গে সুতরাং বাদ দিলে বাকি ৬ নায়ক জাফর ইকবাল, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, আলমগীর, ফারুক এবং তারিক আনাম খানের সাথে এমন সময় অভিনয় করেছেন, যখন তিনি সফলতার চূড়ায় অবস্থান করছেন। এই নায়কদের আজ যে প্রতিষ্ঠিত রূপ আমরা দেখি, তার সূচণা কিন্তু কবরীর হাত ধরেই ঘটেছে।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে তিনি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন সারেং বৌ (১৯৭৮)এ নবিতুন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। এর আগে আরও কিছু পুরস্কার পেলেও ওটাই ছিল প্রথম জাতীয় স্বীকৃতি। শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস সারেং বৌ অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ-আল-মামুন পরিচালিত একই নামের চলচ্চিত্রটি কবরীর ক্যারিয়ারে একটি বাঁক বদলের ছবি। এর পর থেকেই কবরী বেছে বেছে অভিনয় করা শুরু করেন। এসময় তার ব্যাক্তিগত জীবনেও আসে পরিবর্তন। প্রথম স্বামী চিত্ত চৌধুরীকে ছেড়ে দেন এবং নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিবারের বাবু সারোয়ারকে বিয়ে করেন। নাম পাল্টে হয়ে ওঠেন কবরী সারোয়ার। এরপর থেকে পত্র পত্রিকায় কবরীর উপস্থাপনারও পরিবর্তন ঘটে। নায়িকার প্রথাগত গ্ল্যামারাস এবং আবদেনময়ী উপস্থাপন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন তিনি।
আশির দশকে মাত্র ১০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও বের করে নিয়ে আসেন দেবদাস (১৯৮২) এবং দুই জীবন'র (১৯৮৮) মত ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। দেবদাসে কবরীর অনবদ্য অভিনয় করেন। হৃদয় কেড়ে নেন আমজনতার পাশাপাশি সমালোচকদেরও। তবে দুই জীবন চলচ্চিত্রে তিনি কলেজ শিক্ষকের ভূমিকায় হয়ে ওঠেন অতুলনীয়। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটিতে তিনি তার মেলোড্রামাটিক লুক (আদল), এবং অভিনয়ের ধরণে পরিবর্তন নিয়ে আসেন। আর এখান থেকেই তার পরবর্তী কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষক, উকিল, মানবাধিকারকর্মী এমন সব চরিত্রের দিকে জোর দিতে থাকেন। ফলে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের পুরোটা সময়জুড়ে তিনি নিজেকে তৈরি করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে রাজনৈতিক পরিসরে প্রবেশের দ্বার হিসেবে। এরই পরম্পরায় ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে নারায়নগঞ্জ-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় পোস্টারে নিজ পরিচয় হাজির করেন 'সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব' হিসেবে। এদিকে নব্বই থেকে মূলধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি নির্মাণ করেন শর্ট ফিল্ম একাত্তরের মিছিল (২০০১) এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য আয়না (২০০৬) নামের দু'টি চলচ্চিত্র। অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে বানানো আয়না (২০০৬) তাকে পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়, মুঠোয় তুলে দেয় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার।
ঢাকাই চলচ্চিত্রে কবরী আইকন হয়ে উঠেছিলেন 'মিষ্টি মেয়ে' নামে। সেই যে শুটিং এর ফাঁকে, কবরীকে সাজাতে সাজাতে একদিন ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন 'তুই কি জানিস তোর চেহারা, তোর কত বড় সম্পদ'। সে তো সত্যি কথাই। তবে একথাও মিথ্যা নয়, সেই মিষ্টি হাসি আর সুন্দর চেহারার জনপ্রিয় কবরীর ফাঁকফোকর গলিয়ে তার ভয়ঙ্কর কঠিন এক রূপও ছিল। সেখানে তিনি কঠোর, নিরঙ্কুশ, প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী আর ভীষণ একা। সেই আদিম অভিশাপের মত প্রবল-মানুষের একা হবার বিস্তৃতি কবরীকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল।
অনেকে বলেছিলেন, এই মেয়ের উচ্চাকাঙ্খার পরিণতিই এই একাকীত্ব। কে বোঝাবে তাদের, এই যে মিনা পাল থেকে মিষ্টি মেয়ে কবরী হয়ে কবরী সারোয়ার, অতঃপর বলিষ্ঠ সারাহ বেগম কবরীর নিরন্তর যাত্রা, সেই পথ ছিল ভয়াবহ কঠিন। সেপথে এর আগে খুব কম মানুষই হেঁটেছেন। বাংলাদেশের আর কোনো নায়িকা কি নিজের চারপাশের কাঁচের দেয়াল ভেঙে এভাবে মানুষের কাতারে বারবার নেমে আসতে পেরেছেন? কবরী পেরেছিলেন। এই পারা তাকে অনন্যতা দিয়েছিল।
গত বছরের এই দিনে করোনায় মারা না গেলে কবরী হয়ত এ বছরে তার নতুন চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট, কাস্টিং নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন। মানুষ পেলেই গড়গড় করে গল্প করতেন। অথবা কোনো আড্ডার আসরে তার প্রতারক প্রেমিক, কিশোরী মায়ের বেদনার বোধ আর অসুখী দাম্পত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে উঠতেন, 'আমি প্রথা ভাঙ্গার দলে'।
প্রথাভাঙ্গা সাহসী অভিনেত্রী, আপনার মিষ্টি হাসি নিয়ে এখন ভালো থাকুন ওপারে।
মনিরা শরমিন: শিক্ষক, চলচ্চিত্র সমালোচক
Comments