‘নায়ক রাজ একজনই’
বাংলা চলচ্চিত্রের রাজ্যে নায়ক রাজ রাজ্জাকের বিচরণ ছিল রাজার মতোই। তার সিনেমা মানেই সুপার ডুপার হিট।
সাধনা, সততা, প্রচেষ্টা এবং সংগ্রাম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব শ্রেণীর দর্শকদের নন্দিত নায়ক।
নায়কদের এই নায়কের চতুর্থ প্রয়ান দিবস আজ।
অবুঝ মন, নীল আকাশের নিচে, স্বরলিপি, ময়নামতি, জীবন থেকে নেয়া, স্মৃতিটুকু থাক, রংবাজ, অশ্রু দিয়ে লেখা, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অশিক্ষিত, সমাধি, অনন্ত প্রেম, মাটির ঘর, ছুটির ঘণ্টা, লাইলি মজনু–এমন অসংখ্য সিনেমার নায়ক তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এই নায়কের প্রয়ান দিবসে স্মৃতিচারণ করেছেন তার সহশিল্পীরা।
নায়ক রাজ্জাক ছিলেন আমার ফিলোসফার: আলমগীর
নায়ক রাজ রাজ্জাক ছিলেন আমার ফিলোসফার, আমার গাইড, আমার বন্ধু। ১৯৭২ সালে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের।
আমার প্রথম সিনেমা জন্মভূমিতে তাকে সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলাম। আমাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য থাকার পরেও দারুণ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায়। কীভাবে হয়েছিল সেটা আর মনে নেই। কিন্তু এতে করে আমার জন্য ভীষণ ভালো হয়েছিল।
আমি তার সাধণার অনুসরণ করতাম। তবে অভিনয়ের অনুসরণ করতাম না। অভিনয় যে সাধনার বিষয় তা রাজ্জাক ভাইয়ের কাছ থেকেই শিখেছি। অভিনয় নিয়ে রীতিমত সাধনা করতেন তিনি। তাকে দেখে আমিও শুরু করি।
তাকে দেখে শিখেছিলাম, চরিত্র যত বড় বা ছোটই হোক না কেন তার জন্য সাধনা করতে হবে। চরিত্রটিকে সঠিকভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তারপর ক্যামেরার সামনে গিয়ে ডেলিভারি দিতে হবে।
যখন মোবাইল ছিল না, রাজ্জাক ভাই আমার বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন করতেন। ফোন করেই বলতেন, কী করছ? বলতাম, কিছু না রাজ্জাক ভাই। তিনি বলতেন, বাসায় চলে এসো। চলে যেতাম তার বাসায়, শুরু হতো আড্ডা। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা আড্ডা দিতাম চলচ্চিত্র নিয়ে, ফেলে আসা জীবন নিয়ে, পরিবার নিয়ে, অভিনয় জীবন নিয়ে। ভাবী রান্না করতেন, দুজনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম। সেই সময়গুলো মিস করি।
আমি কিন্তু অভিনয় হাতে কলমে শিখিনি। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে শেখার বিষয়গুলো চলে আসত। তার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে শিখেছি।
প্রিয় এই মানুষটিকে নিয়ে স্মৃতি বলতে গেলে শেষ হবে না। প্রয়ান দিবসে রাজ্জাক ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করি।
প্রথম সিনেমায় নায়ক রাজ্জাক আমার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন: ববিতা
আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, সেই সময়ে সুচন্দা আপা সিনেমায় অভিনয় শুরু করে দিয়েছেন। একদিন জহির রায়হান ভাই আমাকে সিনেমায় অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব দেন। আমি রাজি ছিলাম না। অনেক অনুরোধের পর অভিনয় করি। সংসার নামের ওই সিনেমায় রাজ্জাক ভাই আমার বাবার চরিত্রে এবং সুচন্দা আপা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন।
জহির রায়হানের পরিচালিত একটি সিনেমায় রাজ্জাক ভাই আমার নায়ক হয়ে এলেন। রোমান্টিক দৃশ্য ছিল। আমার সে কি লজ্জা! যাকে এক সিনেমায় বাবা ডেকেছি, তার সঙ্গে কি না নায়িকা হয়ে রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। পরে, রাজ্জাক ভাই ব্যাপারটি সহজ করে দিয়েছিলেন।
এরপর তো তার সঙ্গে অনেক সিনেমা করেছি। রোমান্টিক সিনেমা, সামাজিক সিনেমা, দেশপ্রেমের সিনেমা। কাজ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি সত্যিকারের একজন ভালো মানুষকে। তিনি নায়ক হিসেবে যেমন বড়, মানুষ হিসেবেও বড়।
ক্যামেরার বাইরে তিনি ছিলেন পরিবারের জন্য নিবেদিত মানুষ। এটা তার বিরাট গুণ ছিল। এজন্যই তিনি সংসার জীবনে সুখী ছিলেন।
যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতেন আমাকে। লক্ষী ভাবীও খুব পছন্দ করেন আমাকে।
চলচ্চিত্রকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। গুণী শিল্পীর প্রয়ান দিবসে একটাই চাওয়া, তার আত্মা শান্তিতে থাকুক।
নায়ক রাজ একজনই: ইলিয়াস কাঞ্চন
নায়ক রাজ রাজ্জাক ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের অভিভাবক। চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা ভালো না। এই সময়ে তার মতো একজন অভিভাবকের খুব দরকার ছিল। রাজ্জাক ভাই বেঁচে থাকলে হয়ত সবাই তার কাছে ছুটে যেতেন। তিনি নেই মানে, আমাদের চলচ্চিত্রের অভিভাবক নেই। নায়ক রাজ একজনই।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল যেন পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন তিনি। আমিও তাকে অসম্ভব সম্মান করতাম।
শিল্পী হিসেবে তাকে নিয়ে বলার মতো সাহস আমার নেই। তিনি কত উঁচু মাপের শিল্পী ছিলেন তা সবাই জানেন। কিন্তু, তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তা আমরা জানি।
'চাঁদ সুরুজ' সিনেমায় প্রথম তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। সেই থেকে শুরু। তারপর দেশে ও বিদেশে কত স্মৃতি।
সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। সহশিল্পীকে আপন করে নেওয়ার বিরাট একটা মন ছিল তার। সহশিল্পীরা ভালো করুক এটা সব সময় চাইতেন।
একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যাই। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন।
এই শূণ্যতা পূরণ হওয়ার নয়: মৌসুমী
নায়ক রাজ রাজ্জাকের প্রয়ানে আমাদের সিনেমায় বিরাট শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু শূণ্যতা হয়ত পূরণ করা সম্ভব। কিন্ত নায়ক রাজের শূণ্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
চলচ্চিত্রের যেকোনো সংকটে তিনি বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর সেই ছায়া আর নেই।
সহশিল্পী হিসেবে তাকে পেয়ে আমার শিল্পী জীবন ধন্য হয়েছে। এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।
তাকে আমি বাবার মতো সম্মান করেছি, আমার অভিভাবক মেনেছি। এই অভিভাবক হারানোর কষ্টটা থেকে যাবে আজীবন।
Comments