ফাহিম সালেহ: বাংলাদেশের স্টার্টআপে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
জোনাকিরা খুব অল্প সময় বাঁচে। কিন্তু, যতদিন বাঁচে, তারা জ্যোতি ছড়িয়ে যায়।
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলাদেশি-আমেরিকান প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ (৩৩) যতদিন বেঁচে ছিলেন, আলো ছড়িয়েছেন জোনাকির মতোই।
ফাহিমের এক ডজনেরও বেশি বন্ধু, সহকর্মী, সহযোগী ও আত্মীয়র সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তারা বলছেন, ফাহিম এমন একজন মানুষ, যিনি ছিলেন উজ্জ্বল ভাবনার ধারক। তিনি বাংলাদেশের স্টার্টআপ অঙ্গনে নতুন আলো ছড়িয়েছেন, যে সার্বক্ষণিক উৎফুল্ল থাকতেন এবং যার মধ্যে শিশুসুলভ কৌতূহল ছিল। তিনি কখনো নিজের শেকড় ভোলেননি এবং রেখে গেছেন উদারতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
২০১৪ সালে ফাহিম বাংলাদেশে আসার পরেই এখানকার অনেক উচ্চাভিলাষী তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তার কাছে তিনি হয়ে ওঠেন তাদের ‘উইলি ওয়োংকা’।
তিনি শুধু বিনিয়োগকারীই ছিলেন না, ছিলেন তাদের বড় ভাইয়ের মতো। বিপদের সময় সবাইকে তিনি আগলে রাখতেন, মেন্টর হয়ে পরামর্শ দিতেন। যাতে করে তারা সর্বোচ্চ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে। ফাহিম ছিলেন তাদের সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা।
ফাহিম চলে যাওয়ার পর একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যা সহসা পূরণ হবে না।
হ্যাকহাউস: যেখান থেকে সবকিছুর শুরু
একজন বন্ধুর মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ আব্দুর রাশিদ তামিক্সিডের সঙ্গে ইন্টারনেটে ফাহিমের পরিচয় হয়। দুই মাস পর তারা মুখোমুখি দেখা করেন, যখন ফাহিম অনেক বছর পর বাংলাদেশে আসেন। ফাহিমের জন্ম সৌদি আরবে, বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আগে ফাহিম ছোট অবস্থায় দুয়েকবার বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু, সেবারই প্রথম তার পৈত্রিক দেশে এসে তিনি স্থাপন করেন এক স্থায়ী সংযোগ।
তামিক্সিড দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের সাক্ষাতের প্রথম দিনেই ফাহিম জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে একটা বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না। তিনি বললেন, একটা টিম জড়ো করতে, যারা কম্পিউটার গেমস নিয়ে কাজ করবে।’
পরের দিন গুলশানের একটা রেস্তোরাঁয় বসে তারা দুই জনে ‘হ্যাকহাউস’ গঠন করার পরিকল্পনা করে ফেললেন। রেস্তোরাঁয় বসেই ফাহিম একটা ডোমেইন কিনে ফেললেন এবং একটা খসড়া ওয়েবসাইটও বানালেন। তিনি তামিক্সিডকে কিছু লোগো ডিজাইন করে ফেলতে বললেন।
সেই রাতেই ওয়েবসাইটে একটা নতুন লোগো সংযোজন করা হলো। আরও শুরু হলো বাংলাদেশের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার খোঁজার কাজ। যারা গেমস তৈরির কাজ করতে পারবেন। পরের দিন সকালেই শুরু হলো হ্যাকহাউসের জন্যে একটা অফিস খোঁজার কাজ।
তামিক্সিড বলেন, ‘সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল। আমরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা একটা দোকান থেকে ঠান্ডা পানীয় কিনে নিলাম। সেসময় রাস্তার একটা ছোট ছেলে এসে আমাদের কাছে পানি চাইল। এটা দেখে ফাহিম বললেন, “চলো আমরা পানি কিনে তৃষ্ণার্তদের দেই।” পরবর্তী দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে ফাহিম ১০ থেকে ১২ বক্স পানির বোতল ও প্রায় ১০০ বোতল কোমল পানীয় রাস্তার মানুষকে দিলেন। এই হলো ফাহিম—তীক্ষ্ণ, স্বতস্ফূর্ত ও উদার।’
‘কেউ তার জনহিতকর কাজগুলো তেমন জানে না। পরবর্তী কোনো সময়ে ফাহিম অনেক স্কুল ও এতিমখানায় কম্পিউটার ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করেন, অনেক বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ট্যাবলেট কম্পিউটার বিতরণ করেন। তিনি তার এই গুণাবলীর কথা কখনো কাউকে জানতে দেননি।’
হ্যাকহাউসের অফিস খোলা হয় বনানীতে। এক মাসের বেশি সময় লেগেছিল এর অভ্যন্তরীণ নকশা করে একটা সুন্দর চেহারা দিতে।
টিমের অনেক সদস্য ফাহিমকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন তিনি অফিসের পেছনে এত টাকা খরচ করছেন? ফাহিম বলেছিল, বাংলাদেশে তিনি শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যে আসেননি। তার মূল উদ্দেশ্য এখানে একটা স্টার্টআপ সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফাহিমের এক চাচা ফাহিমকে হ্যাকহাউস অফিস স্থাপনে সাহায্য করেন।
তার চাচা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটা ছিল নির্বাচনের বছর। দেশে তখন প্রায়ই গণ্ডগোল লেগে থাকত। ওর বাবা খুব চিন্তিত থাকতেন, প্রায়ই আমাকে কল করে ফাহিমের খেয়াল রাখতে বলতেন।’
এই অফিসেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাহিমের সঙ্গে হুসেন এম ইলিয়াস ও সফাত আদনানের দেখা হয়। ইলিয়াস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবকে শিক্ষার্থী ও সাফাত লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট)। তাদেরকে নিয়ে ফাহিম প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাও, বাংলাদেশের প্রথম রাইড শেয়ারিং সার্ভিস।
‘তারা বিকালের দিকে এসে, রাত ১১টা পর্যন্ত ফাহিমের সঙ্গে সময় কাটাতেন। তাদের মধ্যে নতুন আইডিয়া নিয়ে মতবিনিময় হয়’, তার চাচা বলেন।
ফাহিম প্রথম থেকেই একটা পূর্ণাঙ্গ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম শুরু করতে চেয়েছিলেন, যা হবে ই-বের মতো। কিন্তু, বাংলাদেশে লজিস্টিক সার্ভিসেস না থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। সেজন্য পাঠাও এর মতো আইডিয়া দিয়ে শুরু করা হয়।
‘পাঠাও ছিল প্রথমে একটা কুরিয়ার কোম্পানি’, তার চাচা বললেন।
এর মধ্যে হ্যাকহাউসে ফাহিম যেসব গেমসের কাজ করাচ্ছিলেন, তা কিছুতেই তার মনের মতো হচ্ছিল না। সেক্ষেত্রে পাঠাও ফাহিমকে একটা আউটলেট দিলো, যেখানে তিনি তার অফুরন্ত কর্মশক্তি ও আইডিয়াকে কাজে লাগাতে পারেন।
সেই সময় চারিদিকে খুব শোনা যাচ্ছিল যে, গ্লোবাল কোম্পানি উবার ও ভারতীয় ওলা বাংলাদেশে আসছে তাদের রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নিয়ে। ফাহিম চাচ্ছিলেন, তাদের আগেই রাইড শেয়ারিং শুরু করতে। তাই ফাহিম তাড়াতাড়ি পাঠাওকে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে প্রসারিত করেন।
২০১৬ সালের মধ্যদিকে উবার বাংলাদেশে আসার কয় মাস আগেই পাঠাও মোটরবাইক দিয়ে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস শুরু করেন। তখন উবার বা ওলা মোটরবাইক ব্যবহার করতেন না।
আমেরিকার টেক ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ফাহিমের নিবিড় যোগাযোগ পাঠাওয়ের জন্যে যেমন বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসে, তেমনি সৃষ্টি করে একটা গ্লোবাল পরিচিতি।
২০১৯ সালে ফোর্বস পাঠাওকে ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যায়ন করে। যদিও ফাহিম কিছু শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু, মৃত্যুর সময়ও তিনি ছিলেন পাঠাওর বড় একজন অংশীদার।
খেলা শুরু হয়ে গেছে: আলফা পটেটো
বাংলাদেশের স্টার্টআপ ও এর মেধাশক্তি নিয়ে ফাহিমের দৃঢ় আস্থা প্রকাশ পায় মোহা. মাশা মুস্তাকিমের কাহিনী থেকে।
মুস্তাকিম হলেন বাংলাদেশের গেমস স্টুডিও আলফা পটেটোর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী।
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুস্তাকিমের যৌথ প্রতিষ্ঠিত পোর্টব্লিস গেমিং কোম্পানি রিলিজ করে ‘হিরোস অব ৭১’ নামে একটা মোবাইল গেম, যেটা দেশের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। তরুণদের মধ্যে গেমটা যথেষ্ট শোরগোল সৃষ্টি করে এবং তিন দিনের মধ্যে তিন লাখ কপি ডাউনলোড হয়।
এর মোট ডাউনলোড ছিল সাত মিলিয়ন এবং গড়ে প্রতি মাসে তিন লাখ ব্যবহারকারী ছিল। এরপরেও এটা পোর্টব্লিসের জন্যে লাভজনক ছিল না।
আরও নতুন মূলধনের জন্যে মুস্তাকিম ও পোর্টব্লিসের আরও কয়জন সদস্য ২০১৬ সালের এপ্রিলে গুলশানের একটা রেস্তোরাঁয় ফাহিমের সঙ্গে দেখা করল।
‘আমেরিকা থেকে আগত একজন তরুণ তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও উচ্ছল চাঞ্চল্য নিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাল’, মুস্তাকিম ডেইলি স্টারকে বলেন।
সে সময় পোর্টব্লিস টিম ছিল বেশ হতাশ। কারণ গেমসের সাফল্য কোম্পানিকে লাভবান করতে পারেনি।
‘কিন্তু ফাহিমের সঙ্গে কথা বলার ৩০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সবার চোখেই একটা আশার আলো জ্বলে উঠল।’
সেখানে বসেই ফাহিম কোম্পানির একটা ঊর্ধ্ব-মূল্যায়ন ও প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস করে ফেললেন। তিনি তাদেরকে আরও বিনিয়োগ কীভাবে পাওয়া যায় এবং কীভাবে বিদেশে কোম্পানিকে রেজিস্ট্রার করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিলেন।
মুস্তাকিম বলেন, ‘আমার মনকে যেটা আবেগতাড়িত করেছে, তা হলো—কীভাবে পোর্টব্লিসের সব সদস্য উপকৃত হবে এবং সবার অংশীদারিত্ব এতে থাকবে, তা নিয়ে ফাহিমের চিন্তাধারা।’
এরপরেও পোর্টব্লিস আয় বাড়াতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এটা মিনডিফিশার গেমসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। মিনডিফিশার বের করল ‘মুক্তি ক্যাম্প’, যেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোবাইল গেমস প্রকল্প। কিন্তু, যে পরিমাণ প্রচেষ্টা দেওয়া হয়েছিল, সে তুলনায় এটাও আর্থিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
‘২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা আমাদের প্রচেষ্টায় তেমন কোনো রেভিনিউ বাড়াতে পারিনি। কিন্তু, ফাহিম আমাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেই যাচ্ছিলেন। তিনি তার উৎসাহ ও উল্লাস দিয়ে আমাদের মনোবল সবসময় অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন।’
ফাহিম ও মুস্তাকিম শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটা বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মার্কেটের দিকে মনোনিবেশ করেন।
২০১৯ সালের প্রথম দিকে আলফা পটেটো নামে আরেকটা গেমিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হলো, যেটাতে ফাহিম ও আরও কয়জন বিনিয়োগ করে। আলফা পটেটোর একক লক্ষ্য ছিল—আন্তর্জাতিক মোবাইল গেমিং মার্কেট। ফাহিমের নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে আলফা পটেটো আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ভিডিও গেমস পাবলিশার লায়ন স্টুডিওর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে সক্ষম হয়।
২০১৯ সালে আলফা পটেটো ‘হাইপার ক্যাজুয়াল’ গেমসে দারুণ সাফল্য পায় এবং প্রতিষ্ঠার পরে দুইটা বিপুল হিটস গেমস— ‘আই পিল গুড’ ও ‘আইসিং ওন দ্য কেক’ রিলিজ করে। এই গেমসগুলো সারাবিশ্বে ৯৫ মিলিয়ন ডাউনলোড হয়েছে।
সেই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘আই পিল গুড’ আইওএসের ডাউনলোডে শীর্ষ স্থান পায়।
‘যে টাকা আমরা তিন বছরে হারিয়েছি, তা আমরা মাত্র দুই মাসে ফেরত পেয়েছি।’
আলফা পটেটো ‘আইডেল গেমস জেনার’ ট্রেন্ডকে জনপ্রিয় করার জন্য এখন পৃথিবীর গেমস পাবলিশারদের কাছে অতি পরিচিত নাম।
‘এটা এখন বিপুলভাবে লাভবান একটি উদ্যোগ। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমরা ফাহিমের সঙ্গে বসার কথা ছিল। সেটাতো এখন সম্ভব নয়’, টেলিফোনে মুস্তাকিম বলেন।
জোবাইক প্রতিষ্ঠা
ফাহিমের হ্যাকহাউস আরও তিনটা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিল: যেতেছি, যাবে ও বানাইছি।
মেহেদী রেজার ২০১৮ সালে চীনের ই-কমার্স জায়ান্ট আলীবাবাতে কাজ করার সময় ফাহিমের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শামীম আহসান দুই জনকে বছরখানেক আগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
১০ মিনিটের আলোচনায় রেজা বাংলাদেশে একটা বাইসাইকেল রেন্টাল সার্ভিস প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা ফাহিমের সঙ্গে শেয়ার করে। রেজা বলেন, ‘ফাহিম আমাকে আলীবাবার চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন।’ পরে রেজার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর ও তার সহজাত স্বভাবমতো ফাহিম এই উদ্যোগের জন্যে খুব তাড়াতাড়ি প্রাথমিক ফান্ডিং ওয়্যার করে দেন।
‘তিনি শুধু বিনিয়োগকারীই নন, তার চেয়েও বেশি। তাকে ছাড়া আমি জোবাইক প্রতিষ্ঠা করার সাহস পেতাম না’, বলেন রেজা।
সেই বছরের ১৮ জুন জোবাইক সার্ভিস কক্সবাজারে শুরু হলো। দুই চাকার বাইককে ভিড়ের শহরে পরিবহন হিসেবে জনপ্রিয় করার জন্যে। এর ছয় মাসের মধ্যেই এই বাইসাইকেল রেন্টাল সার্ভিস ঢাকাতে প্রচলন করা হলো।
বর্তমানে জোবাইক ৪০০ বাইসাইকেল নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কক্সবাজারে সার্ভিস পরিচালনা করছে। ঢাকার অন্যান্য জায়গায় ও বাংলাদেশের অন্যান্য বড় শহরেও এই সার্ভিসকে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
‘ফাহিমের অনেক রকমের ভাবনা ছিল এবং তিনি আমাদের ভাবনাও শুনতে চাইতেন। আমাদের দেশের স্টার্টআপ ইকো সিস্টেমের জন্যে এটা একটা বিরাট ক্ষতি ও অন্যান্য উন্নতিশীল দেশের জন্যও।’
ফাহিমের সঙ্গে রেজার সর্বশেষ দেখা হয় ২০১৯ সালের অক্টোবরে। যেদিন তিনি না জানিয়ে জোবাইক অফিসে হাজির হয়েছিলেন।
তাদের দুই জনেরই একই ব্র্যান্ড ও মডেলের সানগ্লাস ছিল এবং ফাহিম ভুলে রেজারটা নিয়ে যায়।
‘পরে আমি তাকে কল করে বলি— তুমি আমার সানগ্লাস নিয়ে গেছ, যেটা আরও নতুন। ফাহিম ভাইয়ের সানগ্লাস এখনো আমার কাছে আছে—এটা এখন আমার কাছে অমূল্য।’
যাত্রী আসা-যাওয়া করছে
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আজিজ আমান অন্য একটা কোম্পানিতে কাজ করতেন। তখন ফাহিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং বাস টিকিটিং অ্যাপ ‘যাত্রী’ নিয়ে তার ভাবনা ফাহিমের সঙ্গে শেয়ার করেন।
চার দিন পরে ফাহিম যাত্রীর জন্যে প্রি-সিড বিনিয়োগের আয়োজন করে। প্রি-সিড হলো ছোট বিনিয়োগ, যা দিয়ে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করা যায়।
ফাহিমের নির্দেশনায় আমান ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইউএস হোল্ডিং কোম্পানি ‘যাত্রী’ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং ২৬ মার্চ থেকে এটা ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের সঙ্গে চুক্তি করে টিকিটিং সার্ভিস দেওয়া শুরু করল।
‘এরপর সাধারণ মানুষ ও বাস-মালিকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়ে আমরা ট্র্যাকিং সার্ভিস শুরু করি। যা ছিল একটা স্বতন্ত্র সার্ভিস। কিন্তু, ভ্রমণ প্ল্যানারের অন্তর্ভুক্ত।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যাত্রী বেশ কয়টা সিড বিনিয়োগ গ্রহণ করে, যেটা একটা স্টার্টআপে মালিকানার অংশের বিনিময়ে বিনিয়োগ।
সাধারণত বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি, বিনিয়োগকারী কিংবা সাধারণ লোকদের ফান্ডিং—এসব থেকেই খুব প্রাথমিক বিনিয়োগ একটা ব্যবসাকে চালিয়ে নিতে সহায়তা করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা
নিজের থেকে পুঁজি জমাতে পারবে বা যখন এটা আরও বড় বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করতে পারবে।
যাত্রী বোল্ট, সুপার এঞ্জেল, ফ্যালকন নেটওয়ার্ক ও অন্য বিনিয়োগকারীদের থেকে সিড ফান্ড পায়, যারা অন্য অনেক প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রজেক্টকে সহায়তা করেছে।
বর্তমানে যাত্রী ঢাকা শহরের ৩৩ ভাগ সড়কে সেবা দিচ্ছে। যেখানে গুলশান চাকা, ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট, গ্রীন ঢাকা, ঢাকা চাকা, অগ্রদূত বাস সার্ভিস ও অসীম পরিবহনের চলাচল করে।
যাত্রী ভ্রমণ পরিকল্পনা, ট্র্যাকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট ও টিকিটিং (অনলাইন ও অফলাইন) সার্ভিস দিয়ে থাকে।
‘যাত্রী গড়ার কাজে ফাহিম বিরাট অবদান রেখেছিলেন। তিনি আমাদের টিমকে সক্রিয়ভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি আমাদের ভিশনকে বিশ্বাস করতেন এবং দারুণভাবে সাহায্য করেছিলেন যাত্রীকে বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে। তিনি ছিলেন স্বপ্নদর্শক ও আমাদের একজন বন্ধু’, আরমান আরও বলেন।
অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল স্টার্টআপের খোঁড়াক
২০১৮ সালে ফাহিম অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন। যা সম্ভব্য নতুন মার্কেটের জন্যে ইনকিউবেটর ও বিনিয়োগ সরবরাহ করে।
‘ফাহিম দেখলেন প্রি-সিড ও সিডের মাঝে একটা বিনিয়োগ শূন্যতা এসব অঞ্চলে রয়ে যায়।’ বলেন মেহেদী হাসান ওমি। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটালের একজন বিনিয়োগ পরামর্শদাতা ও ফাহিমের একজন সহযোগী।
অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটালের পোর্টফোলিওর মধ্যে আছে কলম্বিয়ায় পিক্যাপ ও মুভও, নাইজেরিয়াতে গোকাডা, কানাডায় ম্যাডলিপিজ। এ ছাড়াও, কিছু টেক স্টার্টআপে ফাহিমের নিজস্ব বিনিয়োগ আছে।
তার কোম্পানি পোর্টফোলিওর কোম্পানিগুলোকে অপারেশনাল, টেকনিক্যাল ও আর্থিক সহায়তা করে। এসব কোম্পানিগুলো মিলিয়ন লোকের জীবনযাত্রাকে উন্নত করছে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফাহিমের বর্বর হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের জন্যে অপূরণীয় ক্ষতি নয়, বরং তা সারাবিশ্বের জন্যেই। কারণ, তিনি অন্যান্য মহাদেশেও সমস্যা সমাধানে কাজ করছিল। নিজ দেশের জন্যে তার কর্ম ও স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল ‘
(গত বছরের ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ২০ জুলাই দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।)
Comments