১৫ কোটি বছর আগে ডাইনোসর ‘ডলি’ সর্দি-কাশিতে ভুগে মারা যায়!

ছবি: সংগৃহীত

আজ থেকে প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে, বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পশ্চিমের মন্টানা অঞ্চলে লম্বা গলাযুক্ত ডাইনোসর ডলি হাঁচি ও কাশি দিতে দিতে হেঁটে যাচ্ছিল। তার হাঁচির চোটে আশপাশের সব পশুপাখি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। সঙ্গে জ্বরও হয়েছিল বেচারা ডাইনোসরের!

না, এটি হলিউডের জুরাসিক পার্ক বা অন্য কোনো কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক সিনেমার দৃশ্য নয়। প্রখ্যাত মার্কিন কান্ট্রি সিঙ্গার ডলি পার্টনের নামে নাম রাখা 'ডলি' নামের ডাইনোসরের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো কোনো একটি ডাইনোসরের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের প্রমাণ পেয়েছেন।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি নতুন এ গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামের জার্নালে, জানায় সিএনএন।

ডিপ্লোডোসিড জাতের তৃণভোজী ডাইনোসরটি তার লম্বা গলার জন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যেটি লম্বায় প্রায় ৬০ ফুট (১৮ মিটার) দীর্ঘ ছিল।

গবেষণা প্রধান ক্যারি উডরাফ জানান, মৃত্যুর সময় ডলির বয়স ছিল ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তিনি মন্টানার মাল্টায় অবস্থিত গ্রেট প্লেইন্স ডাইনোসর যাদুঘরের জীবাশ্ম বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।

ডলির অসুস্থতার বিষয়ে জানা গেল যেভাবে

১৯৯০ সালে মন্টানার একটি জায়গায় ডলির জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। তার পুরো খুলি, গলা এবং মেরুদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কশেরুকা অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সঙ্গে অন্যান্য ডাইনোসরের দেহাবশেষও পাওয়া যায়। তবে জীবাশ্ম পরীক্ষা করে ডলি পুরুষ না নারী ডাইনোসর ছিল, তা নিশ্চিত হতে পারেননি গবেষকরা।

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ক্যারি ও তার সহকর্মীরা ডলির গলার হাড়গুলোকে আরও ভালো করে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা হাড়ের গঠনে কিছু অস্বাভাবিক স্ফীতি দেখতে পান, যেগুলোর আকার ও রঙ অনিয়মিত।

সিটি ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা খুঁজে পান, ডলির বায়ুথলিতে কোনো এক ধরনের সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় হাড়ের এ ধরনের অনিয়মিত বৃদ্ধি দেখা দেয়। ডাইনোসরটির শ্বাসযন্ত্রের গঠন বেশ জটিল প্রকৃতির। এর বায়ুথলিগুলো ফুসফুসের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।

গবেষকরা ধারণা করছেন, ডলি খুব সম্ভবত ছত্রাকের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। অ্যাসপারজিলোসিস নামের এই রোগটি আধুনিক যুগের পাখি ও সরীসৃপদের মধ্যে প্রচুর দেখা যায় এবং এতে অনেক সময় হাড়েও সংক্রমণ দেখা দেয়। পাখিদের দেহে অ্যাসপারজিলোসিস দেখা দিলে এবং এর চিকিৎসা করা না হলে তাদের অকাল মৃত্যু হতে পারে।

এ থেকে ধারণা করা যায়, অসুস্থ হয়ে হাঁচি ও কাশি দিতে দিতেই ডলির জীবনাবসান হয়।

ডলির দেহে যেভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়ে

গবেষকরা ধারণা করছেন, ডিপ্লোডোসিড প্রজাতির ডাইনোসরটির শ্বাসযন্ত্রে বায়ুথলি থেকে সংক্রমণ গলার হাড়গুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ক্যারি জানান, সব তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে ধারণা করা যায়, ডলি তার জীবনের শেষ বছরে সংক্রমণের শিকার হয় এবং বেশ কিছুটা সময় সে এতে ভুগেছে।

ক্যারি ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো বক্তব্যে আরও জানান, এ অবোধ প্রাণী যেসব উপসর্গে ভুগেছে এবং যেভাবে সংক্রমণের কারণে তার হাড়গুলো স্ফীত হয়ে গিয়েছিল, তা দেখে এবং সে হাড় হাতে নিয়ে আপনি তার জন্য অবশ্যই দুঃখবোধ করবেন।

'আমরা সবাই এসব উপসর্গ সহ্য করেছি, কাশি, নিশ্বাস নিতে কষ্ট, জ্বর ইত্যাদি। আর এখানে আমাদের সামনে ১৫ কোটি বছর আগের এক ডাইনোসরের গল্প, যে ঠিক আমাদের মতোই কষ্ট পেয়েছে এবং রোগে ভুগেছে', যোগ করেন ক্যারি।

হাড়ের স্ফীতিগুলো ১ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচু নয়। ফলে ডলির গলা খুব একটা ফুলে যায়নি। তবে সে খুব সম্ভবত ফ্লু অথবা নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গে ভুগেছে, যার মধ্যে ওজন কমে যাওয়া ও সর্দি অন্যতম।

কীভাবে ডলির ঠাণ্ডা লেগেছিল?

এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুব সহজ কোনো কাজ নয়। বিশেষ করে তথ্যপ্রমাণের একমাত্র উৎস যখন ১৫ কোটি বছর আগের কিছু হাড়গোড়। মূল গবেষক ক্যারির উডরাফের মতে, এ ক্ষেত্রে আরও বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে- ডলির ভোগান্তির জন্য মন্টানার বৈরি পরিবেশই দায়ী।

মন্টানার উষ্ণ ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া ছত্রাকের জন্য খুবই অনুকূল পরিবেশ। হয়তো ডলি অন্য কোনো ডাইনোসরের কাছ থেকে অথবা ভুলবশত ছত্রাকের বীজ খেয়ে ফেলার কারণে আক্রান্ত হয়েছিল।

ডলির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ শতভাগ নিশ্চিত হওয়া আজ আর সম্ভব নয়, তবে এ গবেষণা ডাইনোসরদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে আরও ভালো করে জানিয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

এর আগে, গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের মতো ডাইনোসররাও গেঁটে বাত, ক্যান্সার ও আঘাত থেকে সংক্রমণে ভুগে। এমনকি ২৫ কোটি বছরের পুরনো এক প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে গলগণ্ড রোগেরও লক্ষণ পাওয়া গেছে।

তবে এবারই প্রথমবারের মতো কোনো ডাইনোসরের ফসিলে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেল।

প্যালিওপ্যাথলজি বিজ্ঞানের নতুন এক ধারা। এই খাতে প্রাচীন মানুষ ও প্রাণীদের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা করা হয়।

এ ধরনের গবেষণা থেকে হাড়ে কীভাবে চিড় ধরে এবং কীভাবে তা আবারো জোড়া লেগে যায়, সে বিষয়ে আরও অনেক বেশি জ্ঞান আহরণ সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ছবি: সংগৃহীত

হয়তো আরও নতুন কোনো গবেষণায় জানা যাবে ডাইনোসররা কেবল ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বিশাল আকারের ভয়ংকর প্রাণীই ছিল না, তাদেরও ছিল এক ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ জীবন। তারাও অসুস্থ হতো, হাঁচি-কাশি দিতো এবং কিছুটা মানুষের মতোই তাদের জীবনেও ছিল আনন্দ, বেদনা, হতাশা আর হাহাকার।

এখন বেঁচে থাকলে হয়তো ডাইনোসরদেরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণও হতো এবং তাদেরকেও বুস্টার টিকা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতো।

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

1h ago