বিশ্বজুড়ে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে রসদ যোগাচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি
নাইজেরিয়ায় ২০২০ সালে স্পেশাল অ্যান্টি রোবারি স্কোয়াড (এসএআরএস) নামে পুলিশ ফোর্সের বিশেষ এক ইউনিটের নৃশংস ও বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এতে সংহতি জানিয়ে যেসব যারা আন্দোলনটিতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আটকে দেওয়া হয়। লেনদেনের অন্যান্য পথও যে একই দশা বরণ করে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। আন্দোলনকারীরা তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই শরণাপন্ন হন ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের।
চাইলে প্রচলিত মুদ্রার সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সির অজস্র পার্থক্য বের করা সম্ভব। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বোধ হয় মাধ্যম হিসেবে তাদের ব্যবহারের পার্থক্য। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার এ সময়ে ডিজিটাল মুদ্রাগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক নয়া মাধ্যম হিসেবে কাগুজে মুদ্রার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
'চাহিবামাত্র ইহার বাহককে পাঁচশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে'- ৫০০ টাকার নোটের অতিপরিচিত এই বাক্যটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। চোখ এড়াবার কথা নয়, ঠিক তার নিচেই অবস্থানরত গভর্নরের স্বাক্ষর। ৫০০ টাকার নোটের মতো প্রচলিত মুদ্রাসমূহ সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।
এর বিপরীতে ক্রিপ্টোকারেন্সি পুরোপুরি মুক্ত। কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থা এর মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে না। তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতি ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিটকয়েন পাঠানো সম্ভব। কিন্তু ডলার পাঠাতে গেলে হয়তো ব্যাংকের বা অন্য কোনো সংস্থার বিভিন্ন নিয়মের মারপ্যাঁচে পড়ে বেশ কিছু অর্থ সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটির মূল্য রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে না। সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পক্ষে তাই ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কার্যত অসম্ভব। আর ঠিক এই বিষয়টিই নাইজেরিয়ায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধের পরও টাকা পাঠানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
গ্রাহকের চাহিদা ওপর নির্ভর করে ক্রিপ্টোকারেন্সির দর
ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অনেকে স্বর্ণের সঙ্গে তুলনা করেন। স্বর্ণের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির মজুদও সীমিত। স্বর্ণের যেমন নির্দিষ্ট কোনো বাজারদর নেই, কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থা একে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে না, ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রেও তাই। গ্রাহকের চাহিদাই স্বর্ণ এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির দর নির্ধারণ করে দেয়। তবে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল কোনো ডিজিটাল মুদ্রার কথা যদি বলতে হয় তাহলে 'টেদার'-এর নাম উঠে আসবে। মিয়ানমারের ছায়া সরকার (এনইউজি) টেদারকে আনুষ্ঠানিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১-এর ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে হাজারও প্রাণ ঝরেছে দেশটিতে; অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও শোচনীয়। এই অবস্থায় এই মুদ্রা ব্যবহারের প্রধান কারণ জান্তাবিরোধী আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। টেদার ব্যবহারের ফলে আন্দোলনকারীদের আর্থিক লেনদেনের কোনো তথ্য সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছাবে না। অন্যান্য লেনদেনেও এ মুদ্রা ব্যবহারে করা যাবে। যদিও জান্তা সরকার এনইউজিকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থা
ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত বেলারুশের রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মানবিক ভূমিকা রাখতেও দেখা যাচ্ছে। দেশটিতে বয়সল নামে একটি সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কারণে নিপীড়িত, অভিযুক্ত এবং চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের সহায়তা করে আসছে। এই তহবিলের একটি অংশ আসছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে। সংগঠনটি বিটকয়েন এবং ইথেরিয়াম গ্রহণ করে এবং ইতোমধ্যেই সেখানে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক তহবিলে যোগ হয়েছে।
বেলারুশের প্রতিবেশী এবং অন্যতম সহযোগী রাশিয়াতে বিরোধী মতের ওপর দমন-পীড়ন নতুন কিছু নয়। অবশ্য দেশটিতে কারাবন্দি এলেক্সেই ন্যাভালনি পুতিনবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনে ২০২১-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই বিটকয়েন থেকে গৃহীত তহবিলের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৬ থেকে রাশিয়াতে আন্দোলনকারীরা বিটকয়েন গ্রহণ করছেন। এতে সরকারি নজরদারি ফাঁকি দেওয়া তুলনামূলক সহজ হয়। ন্যাভালনি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক লিওনিড ভলকভের ভাষ্যে, 'আমরা বিটকয়েন ব্যবহার করি, কারণ এটি আর্থিক লেনদেনের সহজ এবং বৈধ একটি মাধ্যম। কর্তৃপক্ষ চায় লেনদেনের প্রথাগত পথগুলো আটকে দিতে, কিন্তু আমাদের হাতে বিটকয়েন রয়েছে। এটি রীতিমতো একটি ইন্স্যুরেন্স।'
ক্যাশ ছাড়া লেনদেন
প্রচলিত মুদ্রা ছাপা থেকে শুরু করে একদম ব্যক্তিপর্যায়ে তার লেনদেন পর্যন্ত সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক বড় ভূমিকা থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্থের ওপর এই সংগঠনগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কমিয়ে আনে। কোভিড জর্জরিত এই সময়ে 'ক্যাশলেস' অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা ডিজিটাল মুদ্রাগুলোর পালে আরও জোর হাওয়া দিয়েছে। সেইসঙ্গে বিটকয়েনের মতো মুদ্রার সরবরাহও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয়ত্তে নয়। অনেক দেশই তাই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকার করছে না। চীনের মতো বহু দেশ আবার নিজেদেরই একটি সরকারি ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলন করতে চাইছে।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, মানুষ এখন কর্তৃপক্ষের বেধে দেওয়া নিয়মের বাইরে গিয়েও আর্থিক লেনদেনে সক্ষম। আর এই সক্ষমতাই কেন্দ্রীভূত, জেঁকে বসা, শক্তিশালী বিভিন্ন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে রসদ জোগাচ্ছে। এই আন্দোলন হতে পারে নাইজেরিয়ায় পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে, হতে পারে বেলারুশের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। নিয়মতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙবার মধ্য দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিছুটা হলেও ক্ষমতা চর্চায় পরিবর্তনের সুর তুলেছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ইয়াংগুনভিত্তিক এক বিজনেস কনসাল্টেন্ট বলছেন, 'যদি অধিকাংশ নাগরিকই নিয়মিত ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার শুরু করে দেয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যত বিলই ছাপুক না কেন, এটি টাকাকে স্রেফ কাগজে পরিণত করবে।'
তথ্যসূত্র:
রয়টার্স, ফরচুন, নিক্কেই এশিয়া, ফোর্বস ও ক্রিপ্টোনিউজ।
Comments