জো রোগান বিতর্ক এবং স্পটিফাইয়ের বিবর্তন

ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার সূত্রপাত হয় যেবার জো রোগানের পডকাস্টে অতিথি হয়ে আসেন ভাইরাসবিদ ড. রবার্ট মেলন। ৩১ ডিসেম্বর প্রচারিত এপিসোডে ড. মেলন সরাসরি নিজের ভ্যাকসিনবিরোধী অবস্থান তুলে ধরেন। মেলন বলেন, যারা ইতোমধ্যে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার কোনো দরকার নেই। তার এই বক্তব্যের আগুনে ঘি ঢালেন রোগানের আরও বেশ কিছু অতিথি, যারা সরাসরি মাস্ক এবং লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

জো রোগানের পডকাস্টে এ ধরনের কাণ্ডকীর্তি দেখে বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের প্রায় ৩০০ জনের একটি দল স্পটিফাইয়ের কাছে খোলা চিঠি পাঠান। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো অনুষ্ঠানগুলো যাতে প্ল্যাটফর্মটি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর এতে একাত্মতা পোষণ করে রক সংগীতশিল্পী নিল ইয়ং ঘোষণা দেন স্পটিফাইয়ে হয় তিনি থাকবেন, নয়তো জো রোগান।

তিনি আরও জানান, সংগীতপ্রেমী মানুষদের কাছে জীবন হুমকিতে ফেলে দেওয়ার মতো বিভ্রান্তিকর তথ্যের সরবরাহ তিনি কখনোই সমর্থন করবেন না।  

জো রোগান। ছবি: সংগৃহীত

জো রোগান এবং তার প্রভাব

যদি প্রশ্ন করা হয়, এই সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষ কাকে সবচেয়ে বেশি শোনে; উত্তরে বোধহয় কোনো সংগীতশিল্পী নয়, জো রোগানের নাম উঠে আসবে। ২০১৯ সালে তার পডকাস্ট 'দ্য জো রোগান এক্সপেরিয়েন্স' মাসে ১৯০ মিলিয়ন বারেরও বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে। ইউটিউবে তার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১২ মিলিয়ন এবং ২০২০ সালে স্পটিফাই ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে ৫ বছরের জন্য তার পডকাস্ট কিনে নেয়। বিচিত্র ঘরানার সব অতিথির সঙ্গে বৈচিত্র্যময় নানা বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেন রোগান।

তার ভাষ্যে, প্রথাগত চিন্তা-চেতনার বাইরে গিয়ে নতুন ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় তার পডকাস্ট। তবে প্রথা ভাঙতে গিয়ে জনস্বাস্থ্যকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলে তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বৈকি।

নিল ইয়ং। ছবি: সিংগৃহীত

কেবল নিল ইয়ং নন  

স্পটিফাইয়ের বিরুদ্ধে কেবল নিল ইয়ং নন, আরও বহু প্রথিতযশা শিল্পী নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। জনি মিচেল থেকে শুরু করে ইন্ডিয়া আরি, গিটারিস্ট নিলস লফগ্রেন প্রমুখ শিল্পী স্পটিফাই থেকে নিজেদের সংগীত সরিয়ে নিয়েছেন। লফগ্রেন তার ওয়েবসাইটে লেখেন, 'যখন এই অসাধারণ মানুষগুলো (চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী) নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে আমাদের সেবা করছে, আমাদের জীবন বাঁচাচ্ছে, তখন আমাদের উচিত অর্থ এবং ক্ষমতার লোভে তাদের থেকে মুখ না ফিরিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো।'  

পডকাস্ট সঞ্চালকেরাও সামিল হয়েছেন এই লড়াইয়ে। অধ্যাপক বেনে ব্রাউন জানিয়েছেন স্পটিফাইয়ের কোভিড সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা যাচাই-বাছাই করে তবেই তিনি তার পডকাস্ট 'আনলকিং আস' এবং 'ডেয়ার টু লিড' নিয়ে ফিরবেন। লেখক রক্স্যান গেও তার পডকাস্ট 'দ্য রক্স্যান গে এজেন্ডা' স্পটিফাই থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। একই পথে হেঁটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভ্রাতুষ্পুত্রী ম্যারি এল ট্রাম্প।

এখানে উল্লেখ করে নেওয়া দরকার যে, বহু শিল্পী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্পটিফাইয়ের অন্যায্য সম্মানী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। বিজনেস ইনসাইডার বলছে, কোন গান একবার শোনা হলে জনপ্রিয়তা ভেদে শিল্পীরা ০.০০৩৩ থেকে ০.০০৫৪ ডলার পেয়ে থাকেন। র‍্যাপার টি-পেইন ডিসেম্বরে এক টুইট করে জানান, একজন সাধারণ শিল্পীর কোনো গান মোটামুটি ৩১৫ বারের মতো শোনা হলে তিনি গড়ে এক ডলার আয় করতে পারেন। অন্য বহু প্ল্যাটফর্মই এর চাইতে অধিক সম্মানী শিল্পীদের দিয়ে থাকে। তবে সে গল্প হবে আরেকদিন।   

মুদ্রার অন্য পিঠ

এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে জো রোগান নিজে কী ভাবছেন? এক ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে তিনি বলছেন, 'আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বিতর্কিত বিষয়গুলোয় অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়ে একটি সার্বিক ভারসাম্য রক্ষা করার।' জো রোগান বয়কটের এই আন্দোলনকে অনেকে আবার বাকস্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, দুজন মানুষের মধ্যকার কথোপকথন কখনো বিপজ্জনক হতে পারে না। এখানে রোগান কোনো কিছু প্রমাণের চেষ্টা করছেন না বরং নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন। জর্ডান পিটারসনের মতো রক্ষণশীল চিন্তকেরা এই ইস্যুতে রোগানকে সমর্থনও জানিয়েছেন।   

স্পটিফাইয়ের বক্তব্য, পরিকল্পনা এবং নতুন এক যুগে প্রবেশ

'গ্রাহক একটি জনি মিচেল বা নিল ইয়ংয়ের গান শোনার সময় যে অর্থ ব্যয় করছে, তার শতকরা ৭০ ভাগই চলে যাচ্ছে রেকর্ড লেবেল এবং শিল্পীর পকেটে। কিন্তু যখন কেউ জো রোগান শুনছে, তখন পুরো টাকাটাই পাচ্ছে স্পটিফাই', মার্ক স্যাভেজ, বিবিসি। এটি ভাবা তাই অমূলক যে রোগান-ইয়ং দ্বন্দ্বে স্পটিফাই আদর্শবাদী হয়ে ইয়ংয়ের পক্ষ নেবে। শুরুতে লোকসানের মুখ দেখলেও প্ল্যাটফর্মটি শেষ পর্যন্ত তাই প্রতি এপিসোডে গড়ে ১১ মিলিয়নবার শোনা 'দ্য জো রোগান এক্সপেরিয়েন্স'-এর দিকেই হেলেছে। অন্যদিকে, নিল ইয়ংয়ের গানগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে স্পটিফাই জানিয়েছে কোভিড-১৯ নিয়ে আলোচনা রয়েছে এমন এপিসোডগুলোয় তারা নির্দেশিকা যোগ করার ব্যাপারে কাজ করছে।

বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় পডকাস্ট। ছবি: সংগৃহীত

একটি বিষয় এতক্ষণে হয়তো অনেকটাই পরিষ্কার যে স্পটিফাই নিজেদের কেবল 'মিউজিক স্ট্রিমিং' প্ল্যাটফর্মে আটকে না রেখে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো কন্টেন্ট তৈরি কিংবা মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেও প্রকাশ করতে চায়। আর এক্ষেত্রে তাদের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হচ্ছে পডকাস্ট। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি পডকাস্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয়। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তারা গিমলেট মিডিয়া কিনে নেয় যা 'রিপ্লাই অল', 'হোমকামিং'-এর মতো পডকাস্টের ঠিকানা। সেইসঙ্গে, অ্যাঙ্করের মতো প্ল্যাটফর্মও স্পটিফাই নিজেদের দখলে নেয়। যেটি ব্যবহারকারীকে নিজ পডকাস্ট তৈরি এবং তা শেয়ারের সুযোগ দেয়।    

কন্টেন্ট তৈরির জায়গায় পৌঁছালে স্বভাবতই দায়িত্ববোধের বিষয়টি চলে আসে। উঠে আসে সেন্সরশিপ এবং সেটি কতটুকু মানা হবে সেই প্রশ্ন। বহু জায়গায় একে নীতিমালার মোড়কে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়। সময় যত গড়াবে, স্পটিফাই যত বেশি পডকাস্টনির্ভর হবে, কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণ, সেন্সরশিপ বা নিদেনপক্ষে নীতিমালা প্রণয়নের প্রশ্ন তত বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ফেসবুকের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে দেখা গেছে, দেখা গেছে টুইটারেও।  

 

তথ্যসূত্র:
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি  
 

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka sends diplomatic note to Delhi to send back Hasina: foreign adviser

The Ministry of Foreign Affairs has sent a diplomatic note to the Indian government to send back ousted former prime minister Sheikh Hasina to Dhaka.

4h ago