সান্নিধ্যের স্মৃতি: কাজী আনোয়ার হোসেন আমাকে ‘মাসুদ রানা’ লিখতে বলেছিলেন

কাজী আনোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

আশির দশকের বাংলাদেশে খুব কম যুবকই ছিলেন যার মগ্নতা ছিল না 'মাসুদ রানা' থ্রিলারে। অধিকাংশ যুবকই তখন মাসুদ রানার মতো রোমাঞ্চকর চরিত্র হতে চাইতেন। স্বপ্ন দেখতেন রহস্যময়ী সোহানাকে নিয়ে।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, বাংলায়। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি দেশের প্রথম বিনোদন পাক্ষিক 'তারকালোক'-এ। একদিন সেখানে এলেন মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনিও তখন মাসুদ রানার মতো 'রহস্যময় পুরুষ।' বিপুল জনপ্রিয়তার পরও তিনি নিজেকে সব সময় আড়ালে রাখতেন। কোথাও সাক্ষাৎকার দিতেন না। কোথাও ছাপা হতো না তার ছবি। অনেকেরই ধারণা ছিল, কাজী আনোয়ার হোসেনই আসলে 'মাসুদ রানা'।

আমাকে কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন 'তারকালোক'র প্রধান সম্পাদক আরেফিন বাদল। আমার বাড়ি পাংশায় জেনে কাজী আনোয়ার হোসেন বললেন, 'আমার বাপ-দাদার বাড়ি পাংশায়।' আমি বলি, 'জ্বী জানি। বাহাদুরপুর গ্রামের বিখ্যাত কাজী বাড়িতে আমি অনেকবার গেছি। আপনার বাবার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আমি প্রকাশ করেছি মাসিক 'নিপুণ'-এ।'

কাজী আনোয়ার হোসেনের বাবা প্রখ্যাত গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কাজী মোতাহার হোসেন স্থায়ীভাবে ঢাকায় বাস করলেও নিয়মিত যেতেন পদ্মাপাড়ের গ্রামের বাড়িতে। পাংশায় গিয়ে যোগ দিতেন নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে।

মাসুদ রানার স্রষ্টা আমাকে তার সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'রহস্য পত্রিকা'য় লেখা দিতে বললেন। এর কয়েক দিন পরই আমি সেগুনবাগিচা গিয়ে একটি খুনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শেখ আব্দুল হাকিমের কাছে দিয়ে আসি। সেই একবারই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

ছাপা হলো আমার প্রতিবেদন। লেখকের সম্মানী আনতে গেলে কেউ একজন জানালেন, কাজী আনোয়ার হোসেন আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। দেখা হলে তিনি বললেন, 'এর পরের লেখাগুলোর জন্য তোমাকে ৬০০ টাকা করে দিতে বলেছি।' তিনি আরও বললেন, 'তোমার লেখাটি পড়েছি। একটি খুনের ঘটনা তুমি যেভাবে রহস্যময় করে গল্পের মতো করে তুলে ধরেছো তা আমার ভালো লেগেছে।'

আমি বলি, 'অন্য পত্রিকায় লিখলে হয়তো অন্যভাবে লিখতাম। "রহস্য পত্রিকা" বলেই এভাবে লিখেছি।'

এবার তিনি বললেন, 'তুমি রহস্য উপন্যাস লিখলে অনেক ভালো করবে। এরপর যখন আসবে আমি তোমাকে কয়েকটি বিদেশি থ্রিলার দেব। ওগুলো পড়ে একটা উপন্যাসের আইডিয়া তৈরি করবে। তারপর আমরা বসে খসড়া লিখবো।'

'তুমি কি রনজুকে চেনো?' প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বললেন, 'আসাদুজ্জামান রনজু (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব, অর্থমন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক) পাংশার ছেলে। চেনো তাকে?'

আমি বললাম, 'জ্বী, চিনি। আমার ভাইয়ের বন্ধু।'

কাজী আনোয়ার হোসেন বললেন, 'ওকে দিয়ে আমি একটি বই লিখে প্রকাশ করেছি। আরও কয়েকটি লিখছে। এরপর ওকে দিয়ে মাসুদ রানার সিরিজ লেখাব। আমি চাই পাংশার ছেলেরা আমার সঙ্গে কাজ করুক।'

আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'মাসুদ রানার সিরিজ আপনার লেখা না? তিনি সম্ভবত আমার এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, 'মাঝে-মধ্যে অন্যদের দিয়েও লিখিয়ে নেই। তবে পুরো গল্পটি থাকে আমার। চরিত্রগুলোও আমার তৈরি। ওরা শুধু আমার আইডিয়া মতো লিখে দেয়।'

তিনি আমার ঘোর কাটানোর জন্য বললেন, 'আমার এখান থেকে তোমার কয়েকটি উপন্যাস বেরুনোর পর তোমাকেও মাসুদ রানা লিখতে দেব।'

এরপর হঠাৎ করেই ভালো একটি কাজের সুযোগ পেয়ে আমি ব্যাংকক চলে যাই। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া। প্রায় ২৫ বছর পর আমি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেবার তিনি আর লেখালেখি নিয়ে কথা বললেন না। জানতে চাইলেন আমার প্রবাস জীবনের কথা।

বললেন, 'আরেফিন বাদলের ছেলে তো অস্ট্রেলিয়ায় তোমার বাড়িতে থেকেই পড়ালেখা করছে। বাদলও তো গিয়েছিল। সেই তোমার কথা বললো।' চলে আসার সময় তিনি বললেন, 'এরপর যত বার দেশে আসবে আমার সঙ্গে দেখা করবে। পাংশার মানুষের সান্নিধ্য আমার খুব ভালো লাগে।'

আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

আপনি অনন্তলোকে ভালো থাকবেন আমাদের তারুণ্যকালের রহস্যময় রাজপুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন।

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

2h ago