‘ফ্লাইটে যদি একজন ডাক্তার থাকত কিংবা আমি যদি ডাক্তার হতাম’

'ফ্লাইটের যাত্রীদের মধ্যে যদি একজন ডাক্তার থাকতেন কিংবা আমি যদি ডাক্তার হতাম, তাহলে হয়তোবা ক্যাপ্টেন নওশাদকে এভাবে অকালে চলে যেতে হতো না।'
বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুমের মৃত্যুর খবর জেনে এই কথাগুলো বলেই আফসোস করছিলেন ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আবদুল করিম।
তিনি ২৭ আগস্ট মাস্কট থেকে ঢাকাগামী বিজি-০২২ ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন। সেই ফ্লাইটে মাঝ আকাশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। সোমবার সকালে ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালের মারা যান এই সাহসী ও দক্ষ পাইলট।
মায়ের মৃত্যুর কারণে মাস্কট থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামের রাউজানে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন আবদুল করিম। ওই ফ্লাইটে ১২৪ জন যাত্রী ছিল।
ওই দিন বিকেলে নাগপুরের ড. বাবা সাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে অবস্থান করা আবদুল করিমসহ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের যোগাযোগ হয়েছিল। সে সময় তারা ঘটনার প্রাথমিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন। ক্যাপ্টেন নওশাদের মৃত্যুর পর এখন দেশে অবস্থান করা সেসব যাত্রীদের সঙ্গে আবারও কথা বলেছে ডেইলি স্টার।
ক্যাপ্টেন নওশাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবদুল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নাগপুর বিমানবন্দরে ফ্লাইট থেকে নামানোর সময় ককপিটের অনেকটা কাছাকাছি থাকায় আমি তাকে (ক্যাপ্টেন নওশাদ) পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলাম। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। সেই চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তার মৃত্যুর খবর শুনে বারবার সেই ছবিটিই ভেসে উঠছে, কতটা যন্ত্রণা নিয়ে আকাশ পথে তিনি আমাদের দেশে ফেরাচ্ছিলেন।'
ক্যাপ্টেন নওশাদের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না ওমানপ্রবাসী অপর ব্যবসায়ী নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আরিফুল ইসলাম। তিনি ছিলেন বিজনেস শ্রেণির যাত্রী। খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন পুরো ঘটনা।
'পাঁচ বছর আগে তার বুদ্ধি ও কৌশলে ১৪৯ জন ওমানপ্রবাসী নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এবার নিজের জীবন দিয়ে তিনি রক্ষা করলেন ১২৪ জন যাত্রীকে। আমরা কখনো তাকে ভুলতে পারবে না', বলেন আরিফুল ইসলাম।
করিম, আরিফের মতো সামনের সারির কয়েকজন যাত্রী ছাড়া বাকিদের কাছে পাইলটের অসুস্থতার খবর ছিল অজানা। অহেতুক আতঙ্ক যেন না ছড়ায়, ক্রুরা তাই বিষয়টি বুঝতেও দেননি। যদি তারা বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। জরুরি অবতরণের অনেক পরে টার্মিনাল লাউঞ্জে অবস্থানের সময় সব যাত্রীরা মূল ঘটনা জানতে পারেন।
ইকোনমি শ্রেণির পেছনের সারির যাত্রী চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মোহাম্মদ নূরুল হুদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মনে করেছিলাম সামান্য বুকে ব্যথায় পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসায় সেরে উঠবেন। কিন্তু, তিনি যে চিরতরে হারিয়ে যাবেন, তা কল্পনাও করিনি।'
জীবন-মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে, তারপরও আবদুল করিমের মতো আরিফ-নুরুল হুদাও মনে করেন ফ্লাইটে একজন চিকিৎসক থাকলে হয়তোবা ক্যাপ্টেন নওশাদ বেঁচে ফিরতেন।
এই যাত্রীদের কাছে থেকে জানা যায়, মাস্কট ছেড়ে আসার প্রায় তিন ঘণ্টা পর ভারতীয় আকাশসীমায় হঠাৎই কেবিনে ঘোষণা আসে, যাত্রীদের মধ্যে কোনো চিকিৎসক আছে কি না? দুইবার ঘোষণা দিয়ে কেবিনে এসেও ক্রুরা সরাসরি চিকিৎসকের খোঁজ করেন। কিন্তু, কাউকে পাওয়া যায়নি।
ফ্লাইটে কেউ একজন যে অসুস্থ হয়েছেন, তা বুঝতে পারলেও তার পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যাত্রীরা। অহেতুক আতঙ্ক যেন না ছড়ায়, তাই কেবিন ক্রুরাও তা জানতেও দেননি।
আবদুল করিমের আসন ছিল ইকোনমি শ্রেণির সামনের সারিতে, বিজনেস শ্রেণির কাছাকাছি। কাজেই পুরো কেবিন তার পর্যবেক্ষণ সীমায় ছিল। তাতে কেবিনে মানে যাত্রীদের মধ্যে যে কেউ অসুস্থ নন, তা অনেকটা নিশ্চিত হতে পারেন এবং ধারণা করেন ক্রুদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়েছেন।
করিম বলেন, 'এক পর্যায়ে কেবিন ক্রুদের একজন কারো কাছে রোমিং ফোন আছে কি না জানতে চান। সৌভাগ্যক্রমে একমাত্র আমার কাছে ছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যবহারের সুযোগ করে দেই। ফোন নিয়ে কেবিন ক্রু ককপিটে চলে যান। পরে কল লিস্টের বেশ কয়েকটি নম্বর দেখে বুঝলাম ফোনে ঢাকাকে ঘটনা জানানো হয়েছিল।'
ফোন দেওয়ার সময় করিম ক্রুর কাছ থেকে জানতে পারেন তাদেরই একজন সদস্য অসুস্থ বোধ করছেন। তবে, কে, তা নিশ্চিত হতে পারেননি করিম।
কিছুক্ষণ পরই একজনের অসুস্থতার কারণে দেখিয়ে নাগপুরে জরুরি অবতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। অবতরণের পর রানওয়েতে থামার সঙ্গে সঙ্গে একটি অ্যাম্বুলেন্স প্লেনের কাছে চলে আসে। দরজা খোলার পর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দুই জন স্বাস্থ্যকর্মী উপরে উঠে আসেন। কিছু পরেই ককপিট থেকে একজন পাইলটকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে যান।
তখনই করিম ও আরিফ বুঝতে পারেন পাইলটদের একজন অসুস্থ এবং পরে জানতে পারেন তিনি প্রধান পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ।
'মাত্র একদিন আগে আমি মাকে হারিয়েছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কীভাবে দেশে ফিরব, সে অস্থিরতা কাজ করছিল। কিন্তু, ক্যাপ্টেন নওশাদের সেই চেহারা দেখার পর সবকিছু ভুলে শুধু একটা ভাবনাই আসে, তিনি ফিরে আসবেন তো?', বলেন করিম।
মাস্কট থেকে ফ্লাইটটি চার ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছিল। বোর্ডিংয়ে আগে দুই ঘণ্টা আর বিমানে তোলার পর যান্ত্রিক ত্রুটির কথা জানিয়ে দুই ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল। তারপর মাঝপথে জরুরি অবতরণে পড়ে যাত্রীদের অনেকেই ধৈর্য হারা হয়ে পড়েছিলেন। ফ্লাইটের মধ্যে অনেকে হট্টগোলও শুরু করে দিয়েছিল। টার্মিনালে যেতে রাজি হচ্ছিল না কোনোভাবেই। অনেকে ঠায় বসেছিলেন ফ্লাইটের মধ্যেই। কয়েকজন যাত্রী কেবিন ক্রুদের ওপরও চড়াও হয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত নামলেও টার্মিনালের লাউঞ্জে অবস্থানের সময়ও আরেক দফা উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সেসময় আবদুল করিম দায়িত্ববোধ থেকেই কয়েকজন সচেতন যাত্রীকে নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছিলেন।
'পরিস্থিতি কতটা গুরুতর ছিল, কী পরিস্থিতিতে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে, না করলে আমাদের কী অবস্থা দাঁড়াত বা কতটা ঝুঁকিতে পড়তাম, ক্রুদের ওপর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে বেশিরভাগ যাত্রীরই জানা ছিল না। অসুস্থতার জন্যে জরুরি অবতরণের বিষয়টিতেও বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না অনেকে। তাদের ধারণা যান্ত্রিক ত্রুটির জন্যই ফ্লাইট নামানো হয়েছে। তা ছাড়া, লাউঞ্জে খাবারের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা, বিকল্প যাত্রার ব্যবস্থা সম্পর্কে আগাম তথ্য না পাওয়ায় অনেকে সংযত থাকতে পারেননি। পুরো পরিস্থিতি জানান পর তাদের উপলব্ধি হয়', বলেন তিনি।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে দক্ষতার সঙ্গে উড়োজাহাজ নিরাপদে অবতরণের জন্য কো-পাইলট মুস্তাকিম আর কেবিনের পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্রুদের চেষ্টার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না এই তিন যাত্রী।
সেদিনই ঢাকা থেকে দুবাই ফ্লাইটের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন তাপসের নেতৃত্বে আট সদস্যের উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছিল নাগপুরে। ১২৪ যাত্রীকে নিয়ে রাতেই ঢাকা ফিরেছিল বিজি-০২২ ফ্লাইটটি। যাত্রীদের শান্ত রাখতে আন্তরিক সহায়তার জন্য আবদুল করিমকে বিশেষ সম্মান দিয়েছিল বিমানের ক্রুরা। ক্যাপ্টেন তাপস নিজেই ককপিটে নিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
আবদুল করিম বলেন, 'এমন সম্মান আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কিন্তু, ক্যাপ্টেন নওশাদের মৃত্যুতে তা ম্লান হয়ে গেছে। যদি তিনি ফিরে আসতেন, তাহলে এ নিয়ে আজীবন গর্ব করতে পারতাম। এখন কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে, ফ্লাইটের যাত্রীদের মধ্যে যদি একজন ডাক্তার থাকতেন কিংবা আমি যদি ডাক্তার হতাম...'
এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Comments