ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এভিয়েশন খাত
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দীর্ঘ কঠিন যাত্রার পর বাংলাদেশের এভিয়েশন খাত অবশেষে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। গত ৩ মাসে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন রুটে পরিচালিত ফ্লাইট ও যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ।
সার্বিক বিবেচনায় খাতটি মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পথে আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই অগ্রগতি স্থানীয় ৩টি বিমান পরিষেবা সংস্থার জন্য বিশাল পরিত্রাণ হয়ে এসেছে। কারণ মহামারির অভিঘাতে গত দেড় বছরে এই ৩টি সংস্থা ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।
৩ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ারের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮০০ কোটি ও ১৫০ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, নিয়মিত ফ্লাইটগুলো আবার চালু হওয়ার কারণে দীর্ঘ ও বিরক্তিকর অপেক্ষার শেষে যাত্রীদের মুখে হাসি ফুটেছে। মাসের পর মাস দেশে আটকে থাকা অভিবাসী শ্রমিকরা এখন তাদের কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। যারা বিদেশে নতুন চাকরিতে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন তারাও ফ্লাইটে চড়ছেন। এ ছাড়া দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যও এটি নতুন একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
গত বছরের মার্চে দেশে মহামারি আঘাত হানার পরের ১ বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র গুটিকয়েক ফ্লাইট ছেড়ে যায়। যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল চার্টার্ড ও মালবাহী বিমান। এ সময় প্রায় সবগুলো আন্তর্জাতিক রুটে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরটি এখন পুনরায় অভ্যন্তরীন ও বিদেশগামী যাত্রীদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রায় ২৮টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে।'
তিনি জানান, ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের বেশি যাত্রী উড়াল দিচ্ছেন। যার মধ্যে অনেকেই প্রবাসী কর্মী। ৩ মাস আগে এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজারের মধ্যে।
বর্তমানে এই বিমানবন্দর থেকে দৈনিক ৮০টি ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
বেবিচক চেয়ারম্যান আরও বলেন, গত ৩ মাসে ফ্লাইটের সংখ্যা বেড়েছে ৩ গুণ।
আর মহামারির আগে দৈনিক পরিচালিত ফ্লাইটের সংখ্যা ছিল ১২০টি।
বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু সালেহ মোস্তফা কামাল জানান, মহামারির জন্য সংস্থাটি এর প্রায় সবগুলো গন্তব্যে (১৮টি) ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারেনি। আর এটি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার সময় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই সংস্থাটি তার যাত্রীবাহী বিমান ব্যবহার করে বিশেষ ও চার্টার্ড ফ্লাইটের পাশাপাশি এয়ারফ্রেইট পরিষেবা পরিচালনার মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। কারণ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে সংস্থাটি তখন তহবিল সংকটে ভুগছিল।
বিমানের এমডি বলেন, 'বিমান এখন মহামারিজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এটি এর ১৮টি আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে ১৫টিতে ফ্লাইট চালু করেছে।
'অভ্যন্তরীণ রুটে আমরা ধারণক্ষমতার ৭০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে উড়াল দিচ্ছি। আন্তর্জাতিক রুটে এই হার ৮০ শতাংশ।'
বিমানের সিইও আরও বলেন, 'এই মুহূর্তে আমরা ব্রেক ইভেন পয়েন্টে আছি। যদি চলতি ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে বিমান দ্রুত শক্ত পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।'
বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর চিত্রও একই রকম
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম জানান, তারা তাদের ৯টি আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে ৭টিতে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছেন।
ঢাকা এয়ারপোর্ট সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি এই বিমান সংস্থাটি দেশের ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে ৩৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। যা প্রায় মহামারির আগের অবস্থার মতো।
অভ্যন্তরীন রুটে সংস্থাটি এখন ধারণক্ষমতার ৮০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করছে। মহামারির আগে যা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ছিল জানিয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, 'যদি সবকিছু এখনকার মতোই থাকে, তাহলে আগামী ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে আমরা মহামারির পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারব।'
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমানও বলছেন, অভ্যন্তরীণ রুটে ফাইট চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে।
তিনি জানান, নভোএয়ার এখন ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে তাদের মোট ধারণক্ষমতার বিপরীতে ৭০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
অভিবাসী শ্রমিকরা কাজে ফিরছেন
কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সীমান্ত খুলতে শুরু করেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, ওমান, কাতার ও কুয়েত এ ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর বিভিন্ন দেশ তাদের ভূখণ্ডে বাংলাদেশিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আরোপ করে। এতে করে হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকের পাশাপাশি বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়া অনেক শিক্ষার্থীরা দেশে আটকা পড়েন।
কয়েক মাস আগে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন, যেমন- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো শিক্ষার্থী ভিসা দিতে শুরু করে।
চলতি মাসের শুরুতে দেশে আটকে পড়া প্রায় ৩৫ হাজার প্রবাসী শ্রমিক সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরতে শুরু করেন।
রিক্রুটিং এজেন্সি ওয়েলফেয়ার অরগানাইজেশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ফখরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা আশা করছি অন্যান্য দেশও আমাদের দেশের দক্ষ কর্মীদের ভিসা দিতে শুরু করবে। ইউরোপের দেশগুলোর শ্রমবাজারও খুলছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতি বিদেশে আরও কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে।'
নতুন নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ শ্রমিক সৌদি আরবে যাচ্ছেন মন্তব্য করে ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের নতুন কাজের সুযোগ তৈরির জন্য ওই সব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments