নৃশংস গণহত্যার সাক্ষী লিসবন এখন ‘সিটি অব টলারেন্স’

লিসবনের প্রাণকেন্দ্র লারগো ডি সাও ডমিংগো স্কয়ার। ছবি: স্টার

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের প্রাণকেন্দ্র রসিও ও প্রাসা ডি ফিগুরিয়া মাঠের পাশে লারগো ডি সাও ডমিংগো স্কয়ার প্রতিদিন হাজারো মানুষে উপস্থিতিতে মুখরিত থাকে। বিশ্বের নানা প্রান্তের শত শত পর্যটক এখানে আসেন।

কিন্তু, কয়জনই বা জানেন সেখানকার স্মৃতিস্তম্ভগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তা? সেখানকার সাও ডমিংগো গির্জাকে ঘিরে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের কথা?

গ্রিসের রাজধানী এথেন্স ও ইতালির রাজধানী রোমের পরই বিশ্বের তৃতীয় প্রাচীন শহর লিসবন। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই শহরেই ১৫০৬ সালে ঘটেছিল জঘন্যতম গণহত্যা। এর কেন্দ্র ছিল সাও ডমিংগো গির্জা। সে সময়ে পর্তুগালে মহামারি ও খরা চলায় দেশটি কঠিন সময় পার করছিল।

দিনটি ছিল ১৯ এপ্রিল ইস্টার সানডে। খ্রিষ্টানদের বিশেষ এই দিনে সবাই যখন গির্জায় একত্রিত হয়ে খরা ও প্লেগের অবসানের জন্য প্রার্থনা করছিলেন হঠাৎ সেসময় এক চিলতে আলোকরশ্মি যিশুর মূর্তির ওপর এসে পড়ে। ক্যাথলিক পাদ্রি তখন একে মসিহর বার্তা বা অলৌকিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সবাই যখন ঘটনার প্রশংসায় ভাসছিলেন, তখন একজন বলেন, এটি নিছক সূর্যের আলোর প্রতিফলন ছিল।

লিসবন গণহত্যার কেন্দ্র সাও ডমিংগো স্কয়ারের সাও ডমিংগোর গির্জার ভিতরের দৃশ্য। ছবি: স্টার

সেই ব্যক্তি ছিলেন ইহুদি। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছেন। এ কথায় ক্ষিপ্ত গির্জাভর্তি প্রার্থনাকারীদের একটি দল তাকে চুল ধরে টানতে টানতে গির্জার বাইরে নিয়ে আসে এবং পিটিয়ে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, তার দেহ রোসিওতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই ঘটনার পর সেই জায়গা থেকে ডোমিনিকান ফ্রিয়াররা রাস্তায় যে সব নতুন খ্রিষ্টানকে পেয়েছিলেন তাদের হত্যা করে ট্যাগাস বা রসিওতে পুড়িয়ে দেন। সেই রোববার ৫০০-র বেশি মানুষ নিহত হন।

পরদিন ২০ এপ্রিল আরও বেশি সংখ্যক স্থানীয় জনগণ এই হত্যাযজ্ঞে যোগ দেন। ফলে আরও বেশি সহিংসতার সঙ্গে গণহত্যা চলে। নতুন খ্রিষ্টানদের বাড়িঘর ও গির্জা থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পাবলিক স্কয়ারে জীবিত বা মৃত পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

শিশুরাও এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি। উন্মত্ত ক্যাথলিকরা তাদের টুকরো করে ফেলে বা দেয়ালে ছুঁড়ে হত্যা করে। নতুন খ্রিষ্টানদের বাড়িঘর লুট করে। দ্বিতীয় দিনে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।

তখন পর্তুগালে রাজা ম্যানুয়ালের শাসন ছিল। গণহত্যার সময় তিনি লিসবনে ছিলেন না। প্লেগ মহামারি থেকে বাঁচতে লিসবনের বাইরে আব্রান্তেসের ছিলেন। যখন তাকে লিসবনের ঘটনা জানানো হয় তিনি ম্যাজিস্ট্রেটদের পাঠিয়ে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করেন। কিন্তু, ততক্ষণে লিসবনে সহিংসতা ব্যাপক আকারের ছড়িয়ে পড়ে।

তৃতীয় দিন ম্যাজিস্ট্রেটরা শহরে এসে কয়েকজন নতুন খ্রিষ্টানকে উদ্ধার করেন। কিন্তু, এরই মধ্যে ৩ দিনে প্রায় ২ মানুষকে হত্যা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি। পরে ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। কিছু লোক তাদের প্রতিবেশীদেরকেও ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তাদেরও পরিণতি হয়েছিল নতুন খ্রিষ্টানদের মতোই।

পাথরের স্মৃতিফলকে লেখা ইতিহাসের সেই বর্বরোচিত ঘটনা। ছবি: স্টার

রাজা ম্যানুয়াল লিসবনে ফিরে আসার পর ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তি দেন। কয়েকজন পর্তুগিজকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্যদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। গণহত্যার উসকানিদাতা ২ রাষ্ট্রদ্রোহী ডোমিনিকান ফ্রিয়ারের ধর্মীয় আদেশ ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

সাও ডমিংগো গির্জাকে পরবর্তী ৮ বছর বন্ধ করে রাখা হয়। লিসবনের সব প্রতিনিধিকে 'কাউন্সিল অব ক্রাউন' থেকে বহিষ্কার করা হয়।

গণহত্যার পর নতুন খ্রিষ্ট্রানদের বিরুদ্ধে সন্দেহের পরিবেশ পর্তুগালজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পর্তুগিজ ইনকুইজিশন ৩০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদিদের অনেকে হয় পালিয়ে যায় বা দেশ থেকে নির্বাসিত হয়।

এমনকি নির্বাসিত হলেও তাদেরকে দেশত্যাগের জন্য অর্থ দিতে হয়। ক্রাউনের কাছে তাদের সম্পত্তি ত্যাগ করতে বা বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। শুধুমাত্র বহন করা লাগেজ নিয়েই তারা দেশ ছাড়েন।

গণহত্যার পর ইহুদি বংশের ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানরা এখনও পর্তুগিজ রাজার প্রতি গভীর আনুগত্য অনুভব করেন।

ইতিহাসের ওই ঘটনা 'ইহুদি গণহত্যা' হিসেবে স্বীকৃত। একে ধর্মীয় উগ্রবাদের ঘৃণিত দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। এই স্কয়ারে বিশাল পাথরে ইহুদি ধর্মীয় প্রতীক 'স্টার অব ডেভিড' রয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আছে যা পথচারী ও পর্যটকরা চাইলে দেখে নিতে পারেন।

পাথরে পর্তুগিজ ভাষায় লেখা আছে: O terra, nao ocultes o meu sangue e nao sufoques o meo clamor! এর ইংরেজি অর্থ: O earth, do not hide my blood and do not stifle my cry! এখানে মূলত এই গণহত্যাটি যাতে কেউ ভুলে না যায় সেই আহবান করা হয়েছে।

ছবি: স্টার

দ্বিতীয় স্মৃতি ফলকে ৩০টির বেশি ভাষায় লেখা আছে 'লিসবন অ্যা সিটি অব টলারেন্স'। এখানে সব ধর্ম, বর্ণ ও মতের মানুষের সহাবস্থানের বার্তা রয়েছে। ফলে স্কয়ারটি এখন একটি মাল্টিকালচারাল হাব বা বহু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এটি বিশ্বের নানান প্রান্তের মানুষে পদচারণয় মুখরিত থাকে।

তৃতীয় স্মৃতি ফলক—২টি পাথরের স্তম্ভকে একটি লোহার দণ্ড দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি পাবলিক অ্যাপোলজি। অর্থাৎ, ওই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার প্রতীক হিসেবে এটি স্থাপন করা হয়েছে।

গির্জার দরজা বরাবর মাঠের শেষ প্রান্তে অলিভ বা জলপাই গাছ লাগানো হয়েছে যা শান্তি ও সংঘাত নিরসনের প্রতীক।

১৯৫৯ সালের ১২ আগস্ট গির্জায় আগুন লাগলে এর ভেতর ও উপরিভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। সংস্কারের পর ১৯৯৪ সালে গির্জাটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে, ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ভেতরের দেওয়ালের আগুনে পোড়ার চিহ্ন অক্ষত রাখা হয়।

প্রায় ৫০০ বছর আগে ধর্মীয় উগ্রবাদের ফলে লিসবনে যে গণহত্যা হয়েছিল তা একবিংশ শতাব্দীতে এসে আবিষ্কৃত হয়। এভাবেই হয়তো লুকিয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা অজানা রহস্য ও লোমহর্ষক ঘটনা যা কালের বিবর্তনে একদিন বেড়িয়ে আসবে।

মো. রাসেল আহম্মেদ, পর্তুগালপ্রবাসী সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Reforms, justice must come before election: Nahid

He also said, "This generation promises a new democratic constitution for Bangladesh."

6h ago