কার্জন হল, রুটিফল, দাসপ্রথা ও একটি নৌ-বিদ্রোহের আখ্যান

ফলের ভারে নুয়ে থাকা রুটিফলবৃক্ষের শাখা। ছবি: স্টার

উল্লিখিত শিরোনামের ছন্নছাড়া কথামালা কীভাবে প্রাসঙ্গিক হলো, এর একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্কটাই বা কি—শুরুতেই আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।

শত শত বছর ধরে তাহিতি, হাওয়াই ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া রুটিফল ফলছে খোদ বাংলাদেশের রাজধানীর বুকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে। এই ফলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২৩৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহের গল্প।

১৭৬৮ সালে ইংরেজ নাবিক জেমস কুক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাংকস ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজে চড়ে এক অনুসন্ধানমূলক ভ্রমণে বের হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন কোনো গাছের সন্ধান ও ক্রীতদাসদের জন্য সস্তা কোনো খাদ্যের খোঁজ বের করা। ওই অভিযানেই ফরাসি পলিনেশিয়া অঞ্চলের তাহিতি দ্বীপে তারা রুটিফলের গাছের সন্ধান পান। গাছটিতে প্রচুর ফল ধরে এবং অসাধারণ খাদ্যগুণসমৃদ্ধ এ ফল খেয়েই ওই দ্বীপের বাসিন্দারা জীবনধারণ করতেন।

গাছটিকে পেলেপুষে বড় করেছেন ঢাবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জসীম উদ্দিন। ছবি: স্টার

পরে ইংল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আনা ক্রীতদাসদের খাবার হিসেবে এই ফল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট তৃতীয় জর্জ। জেমস কুক ও জোসেফ ব্যাংকসের প্রাথমিক অভিযানের ১৯ বছর পর তিনি এই গাছ আনার দায়িত্ব দেন লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লাইকে।

তবে গাছ, ফলসহ ব্লাই তার ফিরতি যাত্রায় বিদ্রোহের মুখে পড়েন। দ্বীপের বাসিন্দারা তাকেসহ আরও ১৯ নাবিককে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। পরে এই কাহিনি অবলম্বনে ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ লেখক স্যার জন ব্যারোর বিখ্যাত উপন্যাস 'মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি'। ১৯৬২ সালে একই নামে তৈরি হয় একটি চলচ্চিত্র। তাতে অভিনয় করেন মার্লোন ব্র্যান্ডো, ট্রেভর হাওয়ার্ড ও রিচার্ড হ্যারিসের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতা।

গত শতকের ষাটের দশকে ছবিটি মুক্তি পায় ঢাকার মধুমিতা হলেও।

বাংলাদেশে, অর্থাৎ ঢাকায় চলচ্চিত্রের পর্দা থেকেই বাস্তবের জমিনে রুটিফলের গাছ আসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এক কর্মকর্তার হাত ধরে। তিনি এয়ার কমোডর (অব.) জিয়ারত আলী। ২০০০ সালে নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে কলম্বো থেকে এই ফলের একটি গাছ এনে তিনি প্রথমে রোপণ করেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সরকারি বাসভবনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে লাগানো এই রুটিফল গাছটি ১৭ বছর ধরে ফল দিয়ে যাচ্ছে। ছবি: স্টার

পরে ২০০৩ সালে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সময় তিনি এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগকে উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যোগাযোগ করেন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জিয়ারত আলী দুটি শর্তে গাছটি দিতে চেয়েছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগকে। প্রথম শর্তটি ছিল, গাছে ফল ধরলে তাকে খেতে দিতে হবে। আর ভবিষ্যতে এই গাছের একটা চারা তাকে দিতে হবে।

২০০৪ সালের শেষভাগে জিয়ারত আলীর কাছ থেকে পাওয়া গাছটি লাগানো হয় কার্জন হলে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে। পরের বছরেই তাতে ফল ধরতে শুরু করে।

অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, '২০০৫ সালে গাছে প্রথমবারের মতো ফল আসার পর তা জিয়ারত আলীকে খাইয়ে প্রথম শর্তটি পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু পরে তিনি আর চারা নিতে চাননি।'

রুটিফল দর্শন

গতকাল সোমবার উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে বাংলাদেশের মাটিতে বিরল এই গাছটির দেখা মেলে। গাছটির বাহারি সবুজ পাতার অগ্রভাগ দেখতে অনেকটা হাতের আঙুলের মতো। লম্বায় ৩০ ফুটের উপরে। সুন্দর–সুবিন্যস্ত ঘন পাতার কারণে প্রবল রোদের ভেতরেও চারপাশে নিবিড় ছায়া তৈরি হয়ে আছে। ফল দেখতে অনেকটা চাপালিশ কাঁঠালের মতো। অগ্রভাগে ধরে থাকা ফলের ভারে নুয়ে আছে শাখাগুলো। আর বিশেষ করে পাতার বৈশিষ্ট্যর কারণে বাগানের আরও অনেক গাছের ভেতর থেকে এই গাছটিকে খুব সহজেই আলাদা করে চিহ্নিত করা গেল।

শিল্পীর তুলিতে বাউন্টিতে বিদ্রোহ। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক জসীম উদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল, ইংরেজিতে এর নাম 'ব্রেডফ্রুট ট্রি'। বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus altilis। গ্রিক শব্দ আরটস অর্থ রুটি আর কারপাস অর্থ ফল।

উদ্ভিদবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক আরও জানান, পাতলা আবরণ উঠিয়ে ফলটি কাঁচা, পুড়িয়ে, শুকিয়ে গুঁড়ো করে রুটির মতো বানিয়ে কিংবা রান্না করেও খাওয়া যায়। সুষম খাদ্যের সব ধরনের উপাদান ফলটিতে আছে। স্বাদ অনেকটা মিষ্টি আলুর মতো। সাধারণত এপ্রিল থেকে গাছে ফল ধরতে শুরু করে। আগস্টের শুরু থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত একটা বড় আকারের গাছ থেকে ২০০ কেজির বেশি ফল পাওয়া যায়।

রুটিফলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর কোনো বিচি নেই। পুরোটাই শাঁসালো। চারা হয় গাছের মূল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগানো গাছটি থেকে এ পর্যন্ত ২টি চারা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটা চারা লাগানো হয়েছে বাগানের দক্ষিণ পাশে। দেখা গেল, ৬ বছর বয়সের ওই গাছটিতেও ফলে আছে অসংখ্য ফল।

রুটিফলবৃক্ষের পূর্ণ অবয়ব। ছবি: স্টার

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চাষের সম্ভাবনা

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শ্রীলঙ্কা বাদেও বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। এর আগে মালয়েশিয়া সরকারও এই ফল উৎপাদনে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে এর বাণিজ্যিক চাষাবাদ দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও ফ্লোরিডাতেও সম্প্রতি এর বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে।

অধ্যাপক জসীম উদ্দিনের ভাষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটি ২০০৫ সাল থেকে টানা ফল দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে বাংলাদেশের আবহাওয়া–জলবায়ু গাছটি বেড়ে ওঠার উপযোগী। এতদিনে আশপাশের গাছেও এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়নি। অর্থাৎ প্রতিবেশের জন্যও এই গাছটি যে ক্ষতিকর নয়, তা অনেকটা প্রমাণিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এর বাণিজ্যিক চাষ হতে পারে।

ফলের ভারে নুয়ে থাকা রুটিফলবৃক্ষের শাখা। ছবি: স্টার

এই অধ্যাপক বলেন, 'প্রতিটি ফলে ২৭ গ্রাম শর্করা, ১১ গ্রাম চিনি, ৫ গ্রাম আঁশ, শূন্য দশমিক ২৩ গ্রাম চর্বি, ১ দশমিক ০৭ গ্রাম আমিষ, ৭১ গ্রাম পানি এবং ১১ প্রকার ভিটামিন ও ৪ প্রকার খনিজ পদার্থ আছে। অর্থাৎ একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সব উপাদান আছে রুটিফলে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক চাষাবাদের মাধ্যমে যদি এর পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তা দারুণ একটি বিকল্প হতে পারে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।'

এ ছাড়া এই গাছের ঔষধি গুণও চমৎকার। রুটিফলের পাতার ক্বাথ উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্ট উপশম করে। জিহ্বার প্রদাহে পাতা বেঁটে প্রলেপ দেওয়া হয়। এর কষ চর্মরোগ উপশমে বিশেষ উপকারী। অনেক এলাকায় রুটিফল দিয়ে ক্যান্ডি, চিপস, এমনকি মিষ্টি আচারও তৈরি হয়। এ ছাড়া পাখি ধরার ফাঁদ হিসেবে রুটিফল গাছের আঠার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে বিভিন্ন দেশে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণ বাদেও কুমিল্লার বার্ড, ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি রুটিফলগাছ আছে বলে জানান অধ্যাপক জসীম উদ্দিন।

Comments

The Daily Star  | English

5 dead bodies recovered from launch in Meghna

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

29m ago