ভাঙা-গড়ার খেলায় দুর্বিসহ কয়রাবাসীর জীবন
খুলনার কয়রা উপজেলার গতিরঘেরি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন গৌতম দাস। তার চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।
'অনেকেই এলাকা ছাড়ছেন। তাদের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাচ্ছে, আয়-রোজগারও নেই। খাওয়ার পানিটুকুও ঠিক মতো পাওয়া যায় না,' বলেন গৌতম।
গ্রামের প্রায় ৮০টি পরিবার বাঁধের কাছাকাছি জায়গায় খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। প্রায় ৬ মাস আগে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে বাঁধটির অংশবিশেষ ভেঙে যায় এবং গ্রামটি বন্যার কবলে পড়ে। গ্রামবাসীদের বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গবাদি পশু ভেসে যায়। ফলে অনেকেই এখন সব ফেলে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল। স্বভাবতই, খুলনার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত কয়রা উপজেলা প্রায়ই বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা দেশের উপকূলীয় বেল্টে আঘাত হানার পর গ্রামের পর গ্রাম জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় এবং অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
সেবারও বাঁধ ভেঙে পড়ে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় ২ বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল এবং অনেক পরিবারের জন্য বাঁধই ছিল একমাত্র আশ্রয়।
২০১১ সালে বাঁধ মেরামত করা হলে তারা তাদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফিরে যান এবং আবারো শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে বাধ্য হন।
তারপর গত মে মাসে ইয়াস আঘাত হানে। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন তার সবই আবার লবণাক্ত পানির নিচে তলিয়ে যায়।
গ্রামের কলেজ ছাত্র গৌতম বলেন, 'মাটির তৈরি বাঁধটি মেরামত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারছি না। না ফিরতে পারলে কাজ খুঁজে পাবো না। নোনা পানি আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। যার কারণে অনেকেই এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।'
গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত বৈরি প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ উপকূলীয় মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।
তবে প্রখ্যাত পরিবেশবিদ অধ্যাপক আইনুন নিশাত জানান, কয়রার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি দায়ী নয়।
তিনি বলেন, 'যদি বাঁধে ফাটল দেখা দেয়, তাহলে গ্রামে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে এবং মানুষ সব হারায়। যার কারণে তারা বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়।'
তিনি যোগ করেন, 'বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর জন্য মূলত রক্ষণাবেক্ষণকারী কর্তৃপক্ষের অবহেলাই দায়ী।'
কয়েক মাস আগে কয়রার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসেছেন বলেও জানান তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথনে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি জানান, যখনই শাকবাড়িয়া নদীতে জোয়ার আসে, তখনই গতিরঘেরি গ্রামের ৯০টি বাড়ি কোমর পানিতে ডুবে যায়। স্বাভাবিক সময়েও এই এলাকার প্রায় ৯০টি পরিবারের সদস্যরা বাঁধের ওপর বসবাস করতে বাধ্য হন।
বাঁধটি ৭ থেকে ৮ ফুট প্রশস্ত। পরিবারগুলো তাদের খাট, কিছু তৈজসপত্র এবং কয়েক জোড়া কাপড় নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বাকি সবকিছু বাড়িতে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
বাঁধের প্রান্তে গোলপাতা ও পলিথিনের শিট দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী কুটিরে বসে ছিলেন বিজয় সরকার এবং তার স্ত্রী আয়না সরকার।
দূরের একটি জায়গার দেখিয়ে বিজয় বলেন, 'ওই আমার বাড়ি, এখন কোমর পানিতে তলিয়ে আছে।' তার দেখানো জায়গায় টিনের ছাউনি দেওয়া একটি বাড়ির অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিলো।
বিজয় এবং তার পরিবার জীবিকা নির্বাহের সব উপায় হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেন, 'আমার ছেলের ১টি চিংড়ী ঘের, ১টি বড় বাড়ি, কিছু ছাগল, হাঁস ও মুরগী ছিল। কিছুই আর নেই।'
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বিজয় বলেন, 'সামনে শীত আসছে। খোলা আকাশের নিচে কীভাবে এই ঠাণ্ডায় বেঁচে থাকবো, জানি না।'
সুনীতা দাস এবং তার পরিবারও বাঁধের ওপর নির্মিত অস্থায়ী কুটিরে থাকছেন। অন্য অনেকের মতো তিনিও এই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তিনি বলেন, 'অন্য অনেক গ্রামবাসীর মতো আমাদেরও চলে যেতে হবে।'
প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি বয়সী সুনীতা জানান, ৩০ বছর আগে তার বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রায় ৫ বার এই এলাকা পানিতে ডুবেছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের একমাত্র সম্পত্তি এই জমিটি বিক্রি করতে চাই। কিন্তু কেউ এটা কিনতে চায় না। শেষ পর্যন্ত হয়তো জমি বিক্রি না করেই আমাদের চলে যেতে হবে।'
সুনীতা জানান, গ্রামের ৯০টি পরিবারের সবাইকে একই ধরণের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি যোগ করেন, ইতোমধ্যে ১০টি পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ওয়ার্ড কমিশনার হরষিত মণ্ডল জানান, অনেক মানুষ ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, 'আইলার পর থেকেই এমন হচ্ছে।'
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াস আঘাত করার পর ১০০ জনেরও বেশি মানুষ এলাকা ছেড়ে শহরে ও অন্যান্য গ্রামে চলে গেছেন। প্রায় ১ মাস আগে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন নির্বাচনের সময় ২৯২ জন ভোটারের মধ্যে ৪২ জনকে পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, 'মানুষ এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে কারণ এখানে কোনো কাজ নেই। তাদের বাড়ি-ঘর আংশিক ডুবে আছে এবং তাদের চিংড়ী ঘেরগুলো ভেসে গেছে।'
ভুক্তভোগীরা সরকার ও এই এলাকায় কাজ করা এনজিওগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেছে।
তারা জানান, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর শুরুতে তারা চাল ও অন্যান্য শুষ্ক খাবারের মতো কিছু ত্রাণ সামগ্রী পান। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেগুলো দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাসকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ইয়াস আঘাত হানার পর ভুক্তভোগীদের চাল ও অন্যান্য শুষ্ক খাবার দেওয়া হয়েছিল। তিনি যোগ করেন, 'আমরা সদ্য নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরপরই ২ টন চাল বণ্টন করবো।'
অনেকেই কয়রা ছাড়ছেন?
কয়রাকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ নদ এবং কয়রা ও শাকবাড়িয়া নদী। এই উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন হচ্ছে বেদকাশী, যেখানে গতিরঘেরি গ্রাম অবস্থিত।
উপজেলা পরিসংখ্যান দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে কয়রার জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৫৬।
কয়রা উপজেলার পরিসংখ্যান অফিসার মনোজ মণ্ডল বলেন, 'আমরা যদি আমাদের অনুমিত সংখ্যা এবং দেশব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৭ শতাংশকে বিবেচনায় নেই, তাহলে এই উপজেলার জনসংখ্যা ২০২১ সালে ২ লাখ ২৬ হাজার হওয়ার কথা।'
অনেক মানুষ যে এই উপজেলা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন তা প্রমাণের জন্য তিনি আরও জানান, তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, এ অঞ্চলের বর্তমান জনসংখ্যা ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৯২।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছের আলি মোড়ল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা জানতে পেরেছেন ২০০৯ থেকে ২০২০ এর মধ্যে এই ইউনিয়ন ছেড়ে প্রায় ৩ হাজার মানুষ চলে গেছেন।
২০০৯ সালে আইলা এবং ২০২০ এ আম্পান আঘাত হেনেছিল।
তিনি জানান, অল্প কিছু মানুষ ফিরে এলেও বেশিরভাগ ফেরেননি।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেকেই শহর এলাকা ও নিকটবর্তী জেলাগুলোতে চলে গেছেন।
সাতক্ষীরার ৩ উপজেলায়—শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও আশাশুনি—একই পরিস্থিতি।
ক্লিনের (কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন) প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী দীর্ঘদিন ধরে এ ধরণের জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'যদি ঠিকভাবে বাঁধের মেরামত করা না হয়, তাহলে পুরো এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।'
তিনি সরকারকে তাগিদ দেন যত দ্রুত সম্ভব বাঁধ মেরামত করে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে না দিয়ে স্থানীয় সরকার ও জনগোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করতে। 'এই উদ্যোগ নেওয়া হলে বাঁধের পরিস্থিতি ভালো থাকবে', বলেন তিনি।
তিনি জানান, তারা ২০০৯ সালে আইলার পর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন এবং জানতে পারেন, শুধুমাত্র খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, 'আম্পানের পর আমরা আবারো কয়রা ও শ্যামনগরে সমীক্ষা চালাই এবং জানতে পারি, আরও ১৮ হাজার থেকে ২১ হাজার মানুষ এসব এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।'
তিনি যোগ করেন, ইয়াসের পর 'ক্লাইমেট রিফিউজির' সংখ্যা সম্ভবত ৫০ হাজারে পৌঁছেছে।
তিনি আরও বলেন, 'এ ধরণের অভিযোজন বন্ধ করার জন্য সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট কৌশল নেই। আমরা সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই এ ধরণের বিষয়গুলোর মোকাবিলা করার জন্য একটি "উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড" গঠন করতে।'
'শত শত মানুষ খাওয়ার পানির অভাবে ভুগছেন। সব জায়গায় লবণাক্ত পানির ছড়াছড়ি', বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সহকারী কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, ঠিকাদারকে বাঁধ নির্মাণের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তিনি যোগ করেন, 'এ ছাড়াও, যারা দুর্দশায় আছেন এবং কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আমরা এ ধরণের খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখবো।'
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments