৩৫ বছরে অনুপস্থিত ছিলেন না একদিনও, সেই সত্যজিৎ স্যার অবসরে যাচ্ছেন

সত্যজিৎ বিশ্বাস। ছবি: স্টার

সত্যজিৎ স্যার অবসরে যাচ্ছেন। আজ শনিবার তার স্কুল জীবনের শেষ দিন। আজকের পর তিনি আর স্কুলে যাবেন না পড়াতে।

সত্যজিৎ বিশ্বাস তার ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একদিনের জন্যও স্কুলে অনুপস্থিত ছিলেন না। ঝড়-বৃষ্টি-বিয়ে-মৃত্যু কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি স্কুলে উপস্থিতির ক্ষেত্রে।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কুচলিয়া গ্রামে তার বাড়ি। শিক্ষকতা করেন অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক তিনি।

১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করার পর ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিনও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকবেন না। সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন তিনি।

১৯৯০ সালে এক শুক্রবার রাতে নড়াইলের পঁচিশা গ্রামের আরতী বিশ্বাসকে বিয়ে করেন সত্যজিৎ স্যার। বিয়ের অর্ধেক কাজ সেরে নববধূকে রেখে শনিবার সকালে চলে যান স্কুলে। ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান তিনি। বিকেলে ছুটির পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বিয়ের বাকি কাজ শেষ করেন।

১৯৯৩ সালে এক সোমবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তার বাবা মাধব চন্দ্র বিশ্বাস। গ্রামের লোকজন ডেকে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে মৃত বাবাকে রেখে চলে যান ক্লাসে। স্কুল শেষে বিকেলে ফিরে এসে বাবার সৎকার করেন রাতে।

৬০ বছর বয়সী সত্যজিৎ বিশ্বাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কোনোদিন স্কুল ফাঁকি দেব না। বিধাতা আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। প্রতিদিন হাজির হয়েছি স্কুলে। শুধু দুই দিন স্কুলে পৌঁছানোর পর কিছুটা অসুস্থ বোধ করি। একদিন ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ চলাবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই মাঠে। পরে অফিসে নিয়ে মাথায় পানি দিলে আমি সুস্থ হই।'

গুণী এই শিক্ষক বলেন, 'ছোটবেলা থেকে আমি এমন। গ্রামের দিগঙ্গা কুচলিয়া হরিদাসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলজীবনে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে কোনোদিন অনুপস্থিত থাকিনি। অসুস্থতার জন্য দশম শ্রেণিতে দুই দিন অনুপস্থিত ছিলাম।'

বিয়ের পর স্ত্রী আরতী বিশ্বাস প্রথম দিকে একটু রাগ করতেন। পরে সেরা শিক্ষক হিসেবে নানা পুরস্কার পেলে সত্যজিৎ স্যারের ত্যাগকে শ্রদ্ধা করে আসছেন তিনি।

অবসরজীবন কীভাবে কাটাবেন? প্রশ্ন শুনে সত্যজিৎ বিশ্বাসের চেহারা বিষণ্ণ হয়। বলেন, 'তখন বাড়ি বসে কর্মজীবনের কথা ভাবা ছাড়া গতি নেই। আমার গ্রামের মানুষও আমাকে ঠিকভাবে চেনেন না। মনিরামপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও আমার সব পরিচিতি স্কুলকে ঘিরে।'

সত্যজিৎ স্যারের ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির অপেক্ষায় আছেন। মেয়ে পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর পড়ছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্ত্রী গৃহিণী।

ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন বলেন, 'স্যার অন্যরকম মানুষ। আমাদের গণিত পড়ান। কোনো কিছু না বুঝলে বার বার বুঝিয়ে দেন। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, এটা ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।'

৯ অক্টোবর সত্যজিৎ বিশ্বাস বিদায় নিচ্ছেন স্কুল থেকে। তবে রোববার তাকে স্কুল থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তার সততা নিয়ে স্কুলটি গর্ব করতে পারবে আজীবন।

ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, '১৯৯০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি এখানে যোগ দিয়েছি। সেই থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাস আমার সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাকে ছুটি নিতে। কোনো বছর ঐচ্ছিক ছুটিও কাটাননি তিনি। আজ সত্যজিৎ বিশ্বাসের কর্মজীবনের শেষ দিন। তাকে ছাড়তে হবে এটা ভেবে খারাপ লাগছে। তারপরও তাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে চাই।'

উল্লেখ্য, শিক্ষাজীবনে সততার জন্য ইতোমধ্যে সত্যজিৎ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।

Comments

The Daily Star  | English

Extortion will no longer be tolerated: DMP chief

He urged rickshaw drivers to provide the names of the extortionists and promised strict action

33m ago