রাতের রোমাঞ্চকর ট্রেকিংয়ে আন্ধারমানিকের পথে
চোখ মেলতেই দেখি বাস থেমে আছে, আশেপাশের সহযাত্রীরা নেই। ভোর হয়ে এসেছে। আলিকদম চলে এলাম নাকি! সে রকম তো লাগছে না। জানলা দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই। কোনো দোকানের নামের নিচের ঠিকানায় বর্তমান অবস্থান খুঁজতে থাকি। অপরিচিত কোনো জায়গায় কোথায় রয়েছি তা জানার জন্য আদি ও অকৃত্রিম কৌশল। বরাবরের মতো এবারও অব্যর্থ প্রমাণিত কিন্তু অবস্থান জেনে ব্যাপক হতাশ! ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ৯টায় ছেড়ে আসা বাস এখনো চট্টগ্রামে!
ছোটবেলার বরফ-পানি খেলার কথা মনে পড়ে গেল। কে যেন ঘণ্টা দুয়েক আগে বরফ বলে কোথায় চলে গেছে, সামনে-পেছনে-ডানে-বায়ে কোনো গাড়ির নড়ন-চড়ন নেই। যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যে যার মতো ঘুরছে। নিজেরও নামতে হলো। সুপারভাইজারের সঙ্গে দেখা, তিনি বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন, 'ভাই, এ রকম জ্যাম কোনো ঈদের সময়ও দেখিনি'! জানা গেল, দেড় কিলোমিটার সামনে কর্ণফুলী সেতু কিন্তু কতক্ষণে পার হতে পারবো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
হবেই বা না কেন, ১৬ ডিসেম্বর (২০২১) বৃহস্পতিবার পড়ায় শুক্র-শনি মিলিয়ে ছুটি হয়ে যায় ৩ দিন। গেল বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন শেষ হয় সেপ্টেম্বরে। গত এক-দেড় বছরের জমে যাওয়া কাজের চাপ সব সেক্টরেই কম-বেশি ছিল। রুদ্ধশ্বাসে ছোটাছুটির মধ্যে এমন ৩ দিনের ছুটি যেন খাঁচা থেকে পাখির মুক্তি পাওয়ার মতো। এই অত্যধিক মুক্তিই এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে জ্যামের খাঁচা বনে গেছে। গণমাধ্যম বলছে, প্রায় ৩ লাখের বেশি মানুষ এই ছুটিতে কক্সবাজারমুখী। আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য আলিকদম কিন্তু যেতে হবে তো এই পথেই।
বলতে গেলে, এরপর দুপুর অব্দি বাস চললো হামাগুড়ি দিয়ে। অসহনীয়-অদ্ভুতুড়ে জ্যামে সবার প্রাণ-মন ওষ্ঠাগত। কোথায় এখন পাহাড়ি শ্যামলিমায় হারিয়ে যাওয়ার কথা, পড়ে রয়েছি পটিয়া-সাতকানিয়া-চন্দনাইশের হট্টগোলে। চকরিয়া পেরিয়ে সবুজ সাইনবোর্ড নজরে আসে; তাতে লেখা, আলিকদম ৪৩ কি. মি.। এত বিরক্তির মধ্যেও মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায়। বান্দরবান ঢুকতেই আঁকাবাঁকা সাপের মতো পথ। দুধারে পাহাড়ের হাতছানি। নীলাকাশ যেন অনন্ত-অসীম চাটাই, তাতে শুকোচ্ছে পেজা তুলোরূপী মেঘ। এ পথে অফরোডার (জিপ নামে প্রচলিত) গাড়ির চল বেশি, ভেতরে মানুষ আর ছাদে কাঠ, সবজি বা ফল। যে পাহাড়ের জন্য এতো অধীর অপেক্ষা, তার যতো কাছে যাচ্ছি ততোই চিত্ত প্রফুল্ল হয়ে উঠে।
বাস এগিয়ে চলে। সুপারভাইজার হঠাৎ বলে ওঠে, 'ওস্তাদ, ডাইনে থাকেন, বামে "শিক্ষিত স্টুডেন্ট"।' কেউই বুঝে উঠতে না পেরে ইতি-উতি চায়। পরে জানা গেল, শিক্ষিত স্টুডেন্টটি হলো সাক্ষাৎ গরু। বাসজুড়ে একচোট হাসির ঢেউ। রসিক মানুষ বটে। গোটা শিক্ষা জীবনে গরু-গাধা কম তো শুনিনি। শিক্ষকরা এতো দরদ দিয়ে ডাকার ফলে এই দুই প্রাণীটিকে বড্ড আপন মনে হতো।
যথারীতি ইয়াংছা ও কানা মেম্বার ঘাট চেকপোস্টে আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাস এগিয়ে চলে। ইয়াংছা খালে শিশুদের দাপাদাপি পেরিয়ে যাই। বিকট হর্নে চমকে ওঠে আনমনে হেঁটে চলা পাহাড়ি বালক। পিঠে ঝুড়িভর্তি কলার পেছন থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ট্যুর হোস্ট জানিয়ে গেল, 'ভাই, দেখতেই তো পাচ্ছেন জ্যামের অবস্থা। বিকেলে আমাদের রেম্বক পাড়ায় থাকার কথা কিন্তু তা তো আর সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আজকের মধ্যে পাড়ায় না পৌঁছালে আন্ধারমানিক যাওয়াও পিছিয়ে যাবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফিরতে পারবো না। এ জন্য রাতে ট্রেক করে আমরা আজকে যেভাবেই হোক রেম্বক পাড়ায় পৌঁছাব। সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নেন'। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল হাওয়া আর অজানা শিহরণ খেলে গেল। পাহাড়ে অফরুটে দিনের ট্রেকিংই বিপদসঙ্কুল, সেখানে রাতে না জানি কী অপেক্ষা করছে!
সকালে পৌঁছানোর বাস শেষমেশ আলিকদম বাজারে ঢুকলো দুপুর আড়াইটায়। ততক্ষণে সব কিছুতে দেরির সব সময়সীমা পার। তড়িঘড়ি করে খেয়ে-দেয়ে আমতলা ঘাটে এসে দেখি সূয্যি মামা পশ্চিমে বিছানা পাততে শুরু করে দিয়েছেন। ইঞ্জিন লাগানো দুটি নৌকা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ভ্রমণসঙ্গী মোট ১১ জন। এবার তৈন খালে জার্নি বাই বোট। দুধারে সবুজ পাহাড়, মাঝখানে বয়ে চলেছে খালের জলধারা। খালে তেমন পানি নেই। চরে বাদামের চাষ হচ্ছে। জুমের কাজ শেষে পাড়ায় ফিরছে পাহাড়িরা। যত সামনে এগোই পেছনে রেখে যাই নাগরিক কায়-ক্লেশ-কদর্যতা।
পাহাড়ের নিজস্ব একটি গন্ধ রয়েছে। জামপাতা হাতে কচলে নাকে শুঁকলে যেমন মনে হয় তেমনই। সতেজ বাতাস প্রাণে এসে লাগে। বুক ভরে শ্বাস নিই। আহ! নিমেষেই সকল ক্লান্তি-গ্লানি-গরিমা উধাও। হুট করে থেমে যায় ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ। নৌকা চরে বেধে গেছে। লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকা নিয়ে আসা হয় মূল স্রোতে। সব মিলে মিনিট পাঁচেকের মতো। এই সময়টুকু মনে হয় স্বর্গীয়। কেননা ইঞ্জিনের বিকট শব্দ এই পরিবেশে একদম বেমানান। শব্দ বন্ধ হতেই শোনা যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলি। দূরে কোথাও পাতাখসা শব্দ। কলকল জলধ্বনি। দুপাশের পাহাড়ি নিস্তব্ধতা আরও অপরূপ হয়ে উঠে।
আন্ধারমানিকে কী আছে কী নেই; মন চাচ্ছে তৈন খালের তীরেই বসে পড়ি। ঝিরি থেকে জল সংগ্রহ করতে আসা পাহাড়ি মেয়েটার সঙ্গে চলে যাই...
প্রায় ২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে নৌকা এসে থামে তীর সংলগ্ন রেইছা ঝিরির গোড়ায়। খাল ধরে আরও এগোলে দুছরি বাজার, এই পথে যাওয়া যায় ক্রিসতং-রুংরাং। সাঁঝের চাদর টেনে সেদিনের মতো শুয়ে পড়লেন সুয্যি মামা। তীর থেকেই উঠে গেছে ঝিরি। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটলে ঝিরি পেরিয়ে এরপর পাহাড়ি পথ। পাহাড়ে সন্ধ্যা মানেই রাত। নিশীথে দীর্ঘ এই পাথুরে পথ কীভাবে পাড়ি দেবো ভাবতে ভাবতেই হাঁটা শুরু।
ঝিরি আসলে ঝরণার জলপ্রবাহ বা গতিপথ। বান্দরবানের প্রায় সবগুলো ঝিরিই পাথুরে। নুড়ি থেকে একেবারে বিশালাকৃতি পাথর এবড়ো-থেবড়োভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ফাঁক গলে কলকল করে জল বয়ে যায়। পানি কোথাও পা ডোবে তো কোথাও হাঁটু অব্দি। শীতের রাতে প্রথমে পা ভেজাতে মন উসখুস করলেও খানিক বাদে অবশ হয়ে আসে। তখন কীসের কী ঠান্ডা পানি! এছাড়া পাথরে গুঁতো খেয়ে পায়ের নখ ফাটা বা চামড়া ছিলে-ছড়ে যাওয়া তো ধর্তব্যেও আসে না!
ট্রেকিংয়ে প্রথম দিনটি বেশ কষ্টে যায়। হঠাৎ করে চরম কষ্টকর চড়াই-উৎরাই হাঁটায় শরীর বিদ্রোহ করে বসে। পরের দিন থেকে শরীর ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করে। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতয় ঘটেনি, তবে কষ্ট বেড়ে গেল কয়েকগুণ বেশি। এমনিতেই সবাই ১৫ তারিখ অফিস করে রাতের বাস ধরেছে। দিনভর অসহ্য জ্যামে নাওয়া-খাওয়া ছাড়া শরীর এমনিতেই খুব ক্লান্ত, এর সঙ্গে যোগ হলো রাতের ট্রেক। ঘণ্টাখানেক হেঁটেই মনে হলো সব দম শেষ। যে যেখানে পারে শুয়ে-বসে পড়লো। পাহাড়ে রাতের ট্রেকিং সব দিক দিয়েই যেমন বিপজ্জনক, তেমনি রোমাঞ্চকর। কিন্তু প্রথম দিনেই এই রোমাঞ্চ নেওয়া যাচ্ছিল না!
আসার পথে পঞ্জিকা দেখছিলাম, চন্দ্রোদয় বিকেল ৩টা ১৩ মিনিটে। তৈন খাল পেরনোর সময়ও পাহাড়ের চূড়ার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল আবছায়া সাদাটে বৃত্ত। রাত নামতেই সে শুক্লা ত্রয়োদশীর দিকভোলানো চাঁদ। ঝিরির দুপাশজুড়ে পাথুরে দেয়াল, এর ওপরে ঘন গাছপালা। ডাল-পালার ফাঁক দিয়ে এক-আধটু দেখা দিলেও পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ সে পাচ্ছিল না। আমাদেরও তখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। যত দ্রুত সম্ভব ঝিরির 'যন্ত্রণা' পেরিয়ে পাহাড়ে উঠে পড়তে পারলে বাঁচি। কারণ দিনের আলোতে অনিন্দ্য সুন্দর এই ঝিরি রাতে সাক্ষাৎ আতঙ্ক। অসাবধানে পা ফসকালেই মাথা-মুণ্ডু ফেটে চৌচির। কারও পা মচকালেও ধরতে হবে ফেরার পথ।
এই ফাঁকে বলে রাখি, আন্ধারমানিক এমনিতেই দুর্গম এলাকা। কোনোদিক দিয়েই যাওয়াটা সহজ নয়। মোটামুটি সহজ আর সোজা পথ হলো থানচি থেকে রেমাক্রি দিয়ে নৌকায় করে বড় মদক পার হয়ে আন্ধারমানিক যাওয়া। অনেকটা পথ নৌকায় যাওয়া হয় বলে শারীরিক কষ্ট তুলনামূলক কম। আমরা যাচ্ছি অনেকটা মক্কা ঘুরে বিলাত যাওয়ার মতো। পুরোটা পথ আমাদের যেতে হবে হেঁটে। যাত্রাপথে ঝিরি-পাহাড় ছাড়াও আর কী কী পড়বে আমাদের জানা নেই। এ পথ সহজে কেউ মাড়ায় না। আমরা মাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়েছি। আন্ধারমানিক পৌঁছাতে আমাদের প্রধানত দুটো বেজক্যাম্প। প্রথমটি রেম্বক আর অন্যটি মাইকোয়া পাড়া। দুই বেজক্যাম্পের মধ্যে দূরত্ব অনেক। পাহাড়িদেরই সারাদিন লেগে যায় আর আমাদের কথা বলাই বাহুল্য। দুটি পাড়ার মধ্যে আরও অনেক পাড়া পড়ে কিন্তু আমাদের মতো অপরিচিতদের রাখতে চায় না। কাজেই যে কোনো মূল্যে আজ রাতে পৌঁছাতে হবে রেম্বক পাড়া, নয়তো রাত কাটাতে হবে জঙ্গলে!
এদিকে ঝিরি আর শেষ হয় না! অন্ধকার আরও জেঁকে বসে। তাকালে পেছনে কিছু দেখা যায় না; মনে হয়, পথ মুছে গেছে। সামনেও ঘুঁটঘুঁটে আঁধার। এক ভৌতিক টানেল দিয়ে আলো হাতে হেঁটে চলেছে আঁধারের যাত্রীরা। সবার সামনে গাইড। হাঁক-ডাক দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলতে হচ্ছে। ছিলাম সারির পেছনের দিকে। আলোর কোনো বালাই নেই তবুও দুয়েকটি ছবি তোলার চেষ্টায় পেছনে পড়ে গিয়েছি। হঠাৎ সবাই দাঁড়িয়ে গেল। কারও কোনো বিপদ হলো নাকি! পরিস্থিতি এমন, সবার আগে এই চিন্তাই মাথায় আসে। নাহ, খবর ভালো, আজ রাতের মতো ঝিরিপথ শেষ। এরপর পাহাড়ি পথ। আহা, এই বুঝি কষ্ট দূর হলো!
পাহাড় চড়তে গিয়ে বিধিবাম। সঠান খাড়া পাহাড়। দলের একজন একটি অ্যাপসে লগবুকের মতো ভ্রমণের সব তথ্য রাখছিল, যেটা অফলাইনেও কাজ করে। পরে জেনেছিলাম, প্রায় ৭৪ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে আমরা সেদিন উঠেছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পায়ের তলা থেকে মাথা অব্দি ঘেমে উঠলো। প্রতি পদে পদে হাঁটু বুকে এসে ঠেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। রুকস্যাকের সাইড থেকে বোতল বের করে গলা ভেজানোরও উপায় নেই। পা ফসকালেই সোজা গড়িয়ে গিরিখাদে। এদিকে পা চলছে না, একটু দাঁড়িয়ে যে থাকবো এরও উপায় নেই কারণ খাড়া পাহাড় একটানে উঠে গেলে ভালো। দাঁড়ালে মাথা ঘুরতে থাকে। উল্টে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি। সামান্য সমতল জায়গায় মিলতেই পিঠের ব্যাগসহ শুয়ে পড়লো সবাই। যার কাছে যা শুকনো খাবার রয়েছে সবাই গোগ্রাসে গিলছে। পা লম্বা করে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ি। নাম না জানা কোনো গাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ চোখে পড়ে। ওই সময়, সেই চাঁদ, পাহাড় আর আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কিছু সত্য বলে মনে হয় না!
এরপর কতবার যে পাহাড়ে চড়লাম-নামলাম-উঠলাম এর ঠিক নেই। আকাশ ভরা তারা আর তার গা বেয়ে পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গা জুড়ে শিমলতা। এমনিতে পা চলে না আবার হাঁটতে গেলে লতায় আটকে যায়। অন্ধকারে সব লতা-পাতা একই। হাতে-মুখে ঘষা লাগলে জ্বলে উঠে। সে সময় ওসব পাত্তা দেওয়াও বিলাসিতা। হাঁটার কারণে শরীর গরম থাকে কিন্তু নাকে-কানে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা ঠিকই জানান দেয় শীতের তীব্রতা। কখন পৌঁছাবো? কতদূরে রেম্বক পাড়া? এই প্রশ্ন গাইডকে বোধ হয় করা হয়ে গেছে শতবার। অল্পভাষী গাইড প্রতিবারই উত্তর দেন, আর আধঘণ্টা। ঘড়ি ধরে ২ ঘণ্টা হাঁটার পরও এই আধা ঘণ্টা শেষ হয় না! ক্রিস্টোফার নোলানের কোনো সিনেমা চলছে না তো! অন্যকোনো গ্যালাক্সিতে হয়তো আমরা হাঁটছি, যেখানে ৪৬০ সেকেন্ডে এক মিনিট আর আমাদের গাইড ভিনগ্রহী কেউ!
অবিরাম ঝিঁঝিঁ ডাকের তালে তালে আমরা মাতালের মতো হাঁটি। বিচিত্র পশু-পাখির ডাকও শোনা যায়। ভয় ধরে, কেটেও যায়। দূর কোথাও আলোর সংকেত। গাইড সবাইকে সাবধান করে। কথা বলা ও আলো জ্বালানো যাবে না। মিয়ানমার সীমান্তের খুব কাছাকাছি কোনো পাহাড় পেরিয়ে আমরা চলেছি। এসব দুর্গম পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে নাকি আরাকানি সন্ত্রাসী দল লুকিয়ে থাকে।
পথিমধ্যে কয়েকটি পাড়া পড়ে। মুহূর্তে মন খুশিতে নেচে উঠলেও আবার মিইয়ে যায়। এর কোনোটিই আমাদের কাঙ্ক্ষিত পাড়া নয়। যেতে হবে আরও বহুদূর। এর মধ্যে আমরা আরও পাহাড় পেরোই, বন-গাছ-ঝোপ-ঝাড় মাড়াই। এভাবেই চলতে চলতে কোনো এক সময় প্রায় বিদায়ী অগ্রহায়ণের চাঁদ আমাদের পৌঁছে দেয় রেম্বক পাড়ায়। রেম্বক, র্যাম্বক বা র্যাম্বো—নানা উচ্চারণেই শুনলাম পাড়ার নাম।
এমনিতেই পাহাড়িরা সকাল সকাল জাগে আবার সন্ধ্যার পর খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা যখন পাহাড়ে পৌঁছাই তখন রাত ১০টা পার। সবাই ঘুমে কাদা। গাইড পরিচিত একজনকে ডেকে তুললো। তাকে সঙ্গে নিয়ে গেল থাকার ব্যবস্থা করতে। আজ রাতে আর হাঁটতে হবে না এই খুশিতে আমরা আর ঘরের অপেক্ষা করলাম না। যে যেখানে পেরেছে এলিয়ে পড়েছি। শরীরও আর পারছিল না। এর মধ্যে ঘর পাওয়া গেল। হেলান দিয়ে বসা গাছের নিচ থেকে ঘর অব্দি পথটুকু মনে হলো বহু ক্রোশ দূর। কোনো রকম ঠেলে নিজেকে নিয়ে গেলাম। সেই সন্ধ্যা থেকে এখন, কতবার যে গায়ে ঘাম শুকালো তার ইয়ত্তা নেই। এই ঠান্ডায় গোসল করার কথা ভাবাও যাবে না আবার পানিরও সরবরাহ নেই। পাহাড়ে পানির খুব কষ্ট। অনেক নিচ থেকে তুলে আনতে হয়। বিশুদ্ধ পানি বাদই দিলাম, দূষিত পানিও যে কত মূল্যবান তা এ রকম দুর্গম পাহাড়ে এলে বোঝা যায়। গামছা ভিজিয়ে কোনো রকম গা মুছে সটান শুয়ে পড়ি। খেয়াল হয়, আমাদের তো রাতে খাওয়া হয়নি। গাইডও বসে নেই। এর মধ্যেই পাড়ার দু-একজনের সাহায্য নিয়ে রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। ধোঁয়া ওঠা জুম, আলু-চাল কুমড়ার তরকারি আর ডাল মনে হলো অমৃত। এতোক্ষণ অদৃশ্য কোনো যাদুবলে যেন শরীর চলছিল। পেটে দানাপানি পড়তেই গোটা ব্রহ্মাণ্ডের ঘুম যেন আমার চোখে।
ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি প্রায়, কানে এলো হোস্টের নির্দেশনা, আগামীকাল সকাল ৭টার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে এই পাড়া থেকে রওনা না দিলে মাইকোয়া পাড়া পৌঁছাতে রাত ১২টা বাজবে। আন্ধারমানিক মাইকোয়া পাড়া থেকে আরও অর্ধবেলা হাঁটার পথ। কেউ একজন কম্বলের ভেতর থেকে বলে উঠলো, কালকে আগে উঠি তো!
চলবে...
Comments