মেঘ, পাথর আর পাহাড়ের রাজ্যে

ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েল

এখানে সোহাগ পায়ে বর্ষা নামে। ফিনফিনে সাদা শাড়ির মতো ভাসে দলছুট মেঘ। স্বচ্ছ নীল জলরাশিতে পড়ে পাখি ওড়া ছায়া। সবুজে মোড়া পাহাড়ি বৈভবে খেলা করে বিকালের লাল আলো। নীল-সবুজ রঙে মাখামাখি আকাশকে চালচিত্র করে ফুটে উঠে মেঘালয়ের কৌতূহলী পাহাড়। এটা প্রকৃতি কন্যা সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা।

অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গের আধার এই সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র।

ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েল

সারি সারি নয়নাভিরাম চা বাগান আর ছোট বড় পাহাড়ি টিলাকে পেছনে ফেলে আমরাও সেদিন গিয়েছিলাম সাদা পাথর এলাকায়। ভ্রমণ সঙ্গী আমার স্ত্রী সাদিয়া, বন্ধু ইমরান ও 'দি গ্রেট' অপু ভাই।

সুস্মিতা পাত্রের গাওয়া 'সখি বহে গেল বেলা শুধু হাসি খেলা', এই গান শুনতে শুনতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল ভোলাগঞ্জের দিকে। কংক্রিটের ঢালাই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়লো রাস্তার দুপাশে হাওড়ের জলরাশিতে চিকচিক করা সোনামাখা রোদ, সবুজ বনানী ও স্থানীয় মানুষের মাছধরাসহ আরও সুন্দর সব দৃশ্য। এসব দেখতে দেখতে ক্রমশই যেন শেষ হয়ে আসছিল সিলেট থেকে সাদা পাথর এলাকার ৩৩ কিলোমিটার পথের এই দূরত্ব।

ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েল

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল বেশ দূরে থাকা একটি ঘন নীল পাহাড়ে। কোনো ভাবেই যেন চোখ সরানো যাচ্ছিল না। অপু ভাই বললেন, 'এটাই মেঘালয়ের খাসিয়া পর্বতমালা। এই পর্বতমালার কাছাকাছিই যাচ্ছি আমরা।' স্মিত হেসে সাদিয়া যোগ করলো, 'কাছে গেলে তুমি আরও বিস্মিত হবে।' সাদিয়া সরকারি চাকরির জন্য সিলেট জেলায় অবস্থান করার কারণে ইতোপূর্বে দু- একবার এখানে এসেছে। তাই এই জায়গাটি বেশ চেনা তার। যতোই কাছে যাচ্ছি ততোই নীল রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে ভারতের ২১তম অঙ্গরাজ্য মেঘালয়ের মনমোহিনী সৌন্দর্য। বিস্ময় খেলে যায় আমার শরীর, মন ও চোখে।

যাত্রার শুরুতেই অবুঝ বালকের মতো মন ভারী ছিল আকাশের। বিষণ্ণ দুপুরে ভরে ছিল ছন্নছাড়া কালো মেঘের আলো। তাই সাদা পাথর এলাকায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় নিলাম বিজিবির ১০ নম্বর চেকপোস্টে। নদী-পাহাড় ঘেরা এমন মোহময় পরিবেশে আগে কখনও বৃষ্টি দেখিনি। তাই একসময় গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম 'আজি ঝর ঝর মুখরও বাদলও দিনে'। বৃষ্টি সরে যেতেই চারপাশটা একদম ঝা চকচকে হয়ে গেল। সদ্যস্নাত কোনো নববধূর মতোই মনে হলো মেঘ, পাথর আর পাহাড় ঘেরা এখানকার স্বচ্ছ নীল আকাশকে। এমন নীল আকাশের নীচ দিয়ে ধলাই নদের জলে ভেসে চলল আমাদের নৌকা। এগিয়ে যেতে থাকলাম সাদা পাথরের দিকে।

ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েল

নৌকায় উঠে প্রথমেই চোখে পড়লো বাংলাদেশের একমাত্র রোপওয়ে প্রকল্প। বড্ড মলিন মুখে ক্ষয়ে যাওয়া যৌবনের জানান দিচ্ছে যেন। ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ একটি কোম্পানি তৈরি করেছিল এই রোপওয়ে প্রকল্প। ১৯৯৪ সালে স্তিমিত হওয়া ১১ মাইল দৈর্ঘ্যের এই রোপওয়ের টাওয়ার এক্সক্যাভেশনের সংখ্যা ১২০টি। ভোলাগঞ্জে উত্তোলিত পাথর ছাতক সিমেন্ট কারখানায় পাঠানোর জন্যই মূলত এই রোপওয়ে ব্যবহৃত হতো। ইমরান বলে ওঠে, 'রোপওয়ের আদলে এখানে ক্যাবল কার চালু করলে এই এলাকার পর্যটন সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেড়ে যেতো।'

রোপওয়ের দিক থেকে চোখ সরাতেই শুরু হলো আসল বিস্ময়। দূর থেকেই দেখলাম সাদা সাদা মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে আয়েশ করে হেলান দিয়ে কীভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি বাতাসে।

ভাবুন তো, কাঁচের মতো স্বচ্ছ নীল জলে ভাসছে একটি নৌকা। তার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল রঙের পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে খেলছে পলাতক মেঘের দল। পাশ দিয়ে নিদারুণ উদাস ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক দুধ সাদা বলাকা।

ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েল

হ্যাঁ, এমনই এক নৈসর্গিক জগত দেখা যাবে সাদা পাথর ভ্রমণে আসলে। দারুণ প্রশান্তিতে মন ভরে উঠবে। নিমিষেই উবে যাবে বিরামহীন ব্যস্ততার অবাধ্য পরিক্রমার চলমান ছাপ। সুনীল রোশনাইয়ের মায়াময় মন্ত্রমুগ্ধতা খেলা করবে আপনার চোখে মুখে। অবচেতন মনেই বলে উঠবেন 'আহ কী শান্তি'।

অবশেষে নৌকা থামলো ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকায়। নৌকা থেকে নেমেই ধলাইয়ের সুশীতল জলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। মুহূর্তেই শীতল স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সারি সারি ছোট বড় পাথরের ওপর দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলছে ধলাইয়ের স্বচ্ছ নীল জল স্রোতে। হলুদ, কালো ও খয়েরি রঙা পাথরের পরিমাণ নগণ্য হলেও সাদা পাথরের পরিমাণই এখানে বেশি। পানিতে দাঁড়িয়েই স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম খাসিয়া পর্বতমালার ভুবনমোহিনী রূপ। পাহাড়ের গা ঘেঁষা দূরবর্তী ঝর্ণা, পাহাড়ি ঘরবাড়ি আর ঘন অরণ্যের নীলাভ আকাশের ঠাণ্ডা শীতল বাতাসে এ যেন রবীন্দ্রনাথের 'আকুল তিয়াসে প্রেমেরও পিয়াস' কিংবা সুনীলের 'পাথরের ভাঁজ ভেঙে উঠে আসা ঘুমঘুম চোখের শিহরন জাগানিয়া বিস্ময়।

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকায় লেখক ও তার স্ত্রী। ছবি: হাফিজুর রহমান রিয়েলের সৌজন্যে

এখানে দাঁড়িয়ে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে যে ঝর্ণাগুলো দূর থেকে দেখা যায় সেগুলো হলো নোহকালিকাই, ওয়াকাবা, রেইনবো ও সেভেন সিস্টার্স ফলস (পাহাড় থেকে সাতটি ধারা প্রবাহিত হয়েছে বলেই এই ঝর্ণার নাম সেভেন সিস্টার্স ফলস)। এসব ঝর্ণার পানিই মূলত ধলাই নদের প্রধান উৎস। ধলাই নদের বুকে পাঁচ থেকে সাত একর জায়গা জুড়ে যে সাদা পাথরের খনি রয়েছে সেটাই মূলত সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ধলাইয়ের।

এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে কখন যে শেষ বিকেলের প্রান্তে চলে এসেছি, টেরই পাইনি। ধলাই নদের মলয় বাতাস গায়ে মেখে আমরা যখন ফিরছি তখনও আমার দৃষ্টি সাদা পথর, নীল জল আর মেঘালয়ের অসীম সৌন্দর্যের পানে। পাহাড়ে ভাসা দুধ কুয়াশার মতো মেঘগুলো আমাদের বিদায়ের পানে চেয়ে চেয়ে যেন গাইছে 'কবে আর হবে থাকিতে জীবন আঁখিতে আঁখিতে মোদেরও মিলন'। এমন আবহে আমিও গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম 'মোর আরও কথা, আরও কথা ছিল বাকি, আরও প্রেম আরও গান'।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda departs for London

The air ambulance ferrying the former prime minister departed from Hazrat Shahjalal International Airport at 11:47pm

5h ago