আলপনা গ্রাম টিকোইল: যেন পটে আঁকা ছবি
মাটির দেয়াল ও বাড়ির উঠোনে এঁটেল মাটির সঙ্গে নানা প্রাকৃতিক রং মিশিয়ে আঁকা ফুল-পাখি-লতা-পাতাসহ হরেক রকমের চিত্র বদলে দিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকোইল গ্রামকে।
অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক টিকোইল। খাতা-কলমে টিকোইল হলেও লোকমুখে আলপনা গ্রাম নামেই পরিচিত।
বাড়িঘর তো পরিষ্কার রাখতেই হয়, একটু ভিন্নভাবে সাজালে কেমন হয়? এরকম ভাবনা থেকেই গ্রামের নারীরা তাদের রুচি ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন প্রতিটি বাড়ির আলপনায়।
ধারণা করা হয়, আলপনার রীতি শুরু হয়েছে বহুকাল আগে। পূজা-পার্বণে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ির দেয়ালগুলোতে সাদা রঙের ফোঁটার নিচে দাগ দিয়ে আলপনা আঁকা হতো। বিবাহযোগ্যা পাত্রীর বাড়িতেও দেখা যেত নানা রঙে রাঙানো বাড়ির উঠোন-দেয়াল। সেই প্রচলন থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম অঙ্কন ধারা বজায় রেখেছে। বর্তমানে গ্রামের ছোট থেকে বুড়ো সকলেই অংশ নেয় রঙের মেলায়। গ্রামের পরিবেশের মতোই সেখানকার বাসিন্দারাও সবসময় থাকে প্রাণোচ্ছ্বল, সজীব এবং অতিথিপ্রিয়।
রৌদ্রজ্জ্বল কিংবা ঝড়-বৃষ্টিমুখর প্রায় সব মৌসুমেই এই গ্রামে শোভা পায় রং-বেরঙের আলপনা। শুধু আলপনা আঁকাতেই সীমাবদ্ধ নয় গ্রামের বাসিন্দাদের কসরত, আলপনা যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য সমান তালে লক্ষ্য রাখেন আবহাওয়ার দিকেও। বৃষ্টি আসার আভাস পেলেই পলিথিন মুড়ে দেন দেয়ালে-উঠোনে। রং ফিকে হয়ে গেলে কখনো পুনরায় রং করেন আবার কখনো নতুন আলপনা আঁকেন। এভাবেই চলছে আলপনা গ্রামের পরম্পরা।
সবকিছুতে যখন বিশুদ্ধতার ছোঁয়া তখনই চলে আসে রঙের কথা। তবে দারুণ বিষয়, আলপনার জন্য যে রঙ ব্যবহার করা হয় সেগুলোও গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই তৈরি করেন। খড়িমাটি ভিজিয়ে 'আখির' বের করে তা থেকে লাল রং আর আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় সাদা রং।
এ ছাড়া এ অঞ্চলের মাটি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পানির ওপরে সাদা স্তর পড়ে। এই সাদা স্তর দিয়েও সাদা রং তৈরি করা হয়। শুকনো বরই, চূর্ণের আঠা, আমের আঁটির শাঁসচূর্ণ, গিরিমাটি, মানকচু ও কলাগাছের আঠার সঙ্গে রঙের মিশ্রণ কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকার রং তৈরি করা হয়।
আলপনা গ্রামের আরেক বিশেষত্ব হলো, যেসব প্রকৃতিপ্রিয় দর্শনার্থী সেখানে যান তাদের প্রত্যেককে অনুরোধ করা হয় দাসু বর্মণের পরিদর্শন খাতায় তাদের মন্তব্য লেখার জন্য। দেশ-বিদেশের যত ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি সেখানে গিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের অনুভূতির রেশ রেখে গেছেন সেই খাতায়।
আপনিও চাইলে প্রতিদিনকার ব্যস্ততা থেকে একদিন ছুটি নিয়ে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে বা একাই ঘুরে আসতে পারেন মনোমুগ্ধকর গ্রামটিতে। ক্যামেরাবন্দি করে নিয়ে আসতে পারেন শ খানেক সুন্দর ছবি। জীবনে যোগ করতে পারেন স্নিগ্ধ পরিবেশে কাটানো কিছু অভিজ্ঞতা।
যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভাবছেন যাবেন কীভাবে? প্রথমে বাস বা ট্রেনে করে পৌঁছে যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সরাসরি যেতে না পারলে রাজশাহী বাসস্টেশনে বা রেলওয়ে টার্মিনালে নামবেন। রাজশাহী রেল বা বাস স্টেশন থেকে দু মিনিটের পথ হেঁটে রেলগেটে যাবেন। এরপর রেলগেটের কাছে গোলচত্বরের পশ্চিম পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বাসে করে ডাইংপাড়া পৌঁছে আমনুরার উদ্দেশে রওনা দেবেন। সেখান থেকেই পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আলপনা গ্রামে।
Comments