রোমাঞ্চকর ফাইনালে জিতে চ্যাম্পিয়ন ইমরুলের কুমিল্লা

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

হাতে ৬ উইকেট। ২৪ বলে চাই ২৭ রান। এমন সমীকরণে জয়ের পাল্লা অবধারিত ভারী ছিল ফরচুন বরিশালের পক্ষে। কিন্তু গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। মুহূর্তেই পাল্টে গেল সমস্ত হিসাব-নিকাশ। ডেথ ওভারে অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়াল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তানভীর ইসলাম সৈকত আলী ও সাকিব আল হাসানের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট দুটি নেওয়ার পর দুর্দান্ত বল করলেন শহিদুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান ও সুনীল নারাইন। তাদের নৈপুণ্যে ১৫২ রানের লক্ষ্যটা দূর আকাশের তারা হয়ে গেল বরিশালের। রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে ১ রানে জিতে বিপিএলের অষ্টম আসরে চ্যাম্পিয়ন হলো ইমরুল কায়েসের নেতৃত্বাধীন কুমিল্লা।

শুক্রবার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বিপিএলের ফাইনাল হয়েছে একেবারে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মতো। শেষ বলে হয়েছে নাটকীয় ম্যাচটির ফয়সালা। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৫১ রান তোলে কুমিল্লা। জবাবে পুরো ওভার খেলে ৮ উইকেটে ১৫০ রান করতে পারে বরিশাল।

করোনাভাইরাসের কারণে শূন্য গ্যালারিতে শুরু হয়েছিল এবারের বিপিএল। প্লে-অফ পর্ব থেকে পাল্টে যায় গ্যালারির খাঁ খাঁ চিত্র। এলিমিনেটর ম্যাচ দিয়ে মাঠে ফেরে দর্শক। আর ফাইনালে নামে দর্শকের ঢল। স্টেডিয়ামের উপরের তলার গ্যালারির প্রায় পুরোটাই ছিল ভর্তি। তাদের বাঁধভাঙা উল্লাসের মাঝে বিপিএলে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা ঘরে তোলে কুমিল্লা।

বিপিএলে কুমিল্লার এটি তৃতীয় শিরোপা। তিনবার ফাইনাল খেলে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হলো তারা। আসরের সফলতম দলের তালিকায় ঢাকাকে ছুঁয়ে ফেলল কুমিল্লা। ঢাকা অবশ্য তিনবার শিরোপা জিতেছে দুটি ভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে। দুবার ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স ও একবার ঢাকা ডায়নামাইটস নামে।

মাশরাফি বিন মর্তুজার (চারবার) পর প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় সফলতম অধিনায়ক বনে গেলেন ইমরুল। জাতীয় দলের বাইরে থাকা এই বাঁহাতি ব্যাটার জিতলেন দ্বিতীয় শিরোপা। তবে খেলোয়াড় হিসেবে এই নিয়ে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি।

শেষ ওভারে জয়ের জন্য ৬ বলে ১০ রান লাগত বরিশালের। ক্রিজে ছিলেন তৌহিদ হৃদয় ও মুজিব উর রহমান। অন্যদিকে, কুমিল্লার দলনেতা ইমরুল আস্থা রাখেন পেসার শহিদুলের ওপর। স্নায়ুচাপ সামলে প্রথম ৪ বলে তিনি দেন মোটে ৫ রান। পঞ্চম বলে হৃদয় ক্যাচ তুলেছিলেন লং লেগের দিকে। তবে অনেক আগেই বলের নিচে পৌঁছে যাওয়া তানভীর ফেলে দেন ক্যাচ। ম্যাচটাও কি তবে তিনি ফেলে দিলেন তিনি? এমন প্রশ্ন যখন জোরালো, তখন শেষ বলটি শহিদুল করেন অফ স্টাম্পের বাইরে, ফুল লেংথের। এক্সট্রা কভারে ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারেননি হৃদয়। দ্বিতীয় রান নেওয়ার চেষ্টায় রানআউট হয়ে যান মুজিব। তাতে ৩ বলে ১ রানের সমীকরণ মেলানো হয়নি বরিশালের।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

অথচ ফাইনালটি হতে পারত 'সৈকত'ময়। বরিশালের প্রথম তিন ম্যাচ খেলে একাদশে জায়গা হারিয়েছিলেন এই ডানহাতি ব্যাটার। তিনি ফিরলেন একদম ফাইনালে, জিয়াউর রহমানের বদলি হিসেবে। ফিরেই ১১ চার ও ১ ছক্কায় ৩৪ বলে ৫৮ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলেন তিনি। কিন্তু তার বিদায়ের পর কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে বরিশাল।

লক্ষ্য তাড়ায় দ্বিতীয় ওভারেই মুনিম শাহরিয়ারের উইকেট হারিয়ে ধাক্কা বরিশাল। ৭ বল খেলে রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ হন আসর জুড়ে আলো ছড়ানো এই তরুণ। ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক সংযোগ করতে না পেরে তিনি মিড-অনে ক্যাচ দেন ফাফ ডু প্লেসির হাতে। তার হন্তারক শহিদুল।

ক্রিজে গিয়েই মারতে শুরু করেন সৈকত। বাড়তি কোনো ঝুঁকি না নিয়ে বলের মান বিচার করে বাউন্ডারির ফুলঝুরি ছড়ান তিনি। শহিদুলের ওই ওভারের শেষ তিন বলে টানা চার আসে তার ব্যাট থেকে। এরপর সৈকতের আগুনে পোড়েন লাইন-লেংথ নিয়ে ধুঁকতে থাকা মোস্তাফিজ। ইনিংসের একদম প্রথম ওভারে চারটি ওয়াইড দেন এই বাঁহাতি পেসার। চতুর্থ ওভারে আক্রমণে ফিরলে সৈকত তাকে মারেন তিনটি চার।

পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মঈন আলীকে চার-ছক্কায় সীমানার বাইরে পাঠিয়ে সৈকত আনেন ১২ রান। তাতে বরিশালের সংগ্রহ পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ। রেহাই পাননি আবু হায়দার রনিও। শহিদুলের মতো তার ওভারের শেষ তিন বলেও টানা চার হাঁকান সৈকত। মিড উইকেট দিয়ে মারা দ্বিতীয় চারটিতে ফিফটি পূরণ হয়ে যায় তার। মাইলফলকে পৌঁছাতে মাত্র ২৬ বল খেলেন তিনি।

বাঁহাতি স্পিনার তানভীর থামান সৈকতের ঝড়। হাঁটু গেড়ে লং-অন দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন ইমরুলের হাতে। এতে ভাঙে ৫১ বলে ৭৪ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

সৈকতের আগ্রাসনের বিপরীতে ক্রিস গেইলের ভূমিকা ছিল কেবলই দর্শকের। প্রথম ১০ ওভারে ২০ বল খেলেও কোনো বাউন্ডারি মারতে পারেননি তিনি। এই ক্যারিবিয়ান হাত খোলেন মুখোমুখি হওয়া ২১তম বলে। মঈনকে ছক্কায় ওড়ান মিড-উইকেট দিয়ে। আসর জুড়ে নিষ্প্রভ থাকা গেইলের কাছ থেকে ফাইনালে দারুণ কিছু দেখার আভাস মিলিয়ে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি। নারাইনের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান তিনি। রিভিউ নিলেও কাজ হয়নি। ৩১ বলে ১ চার ও ২ ছয়ে গেইলের রান ৩৩।

পয়েন্টে মোস্তাফিজের দুর্দান্ত ক্যাচে সাকিব ফেরেন দ্রুত। তানভীরের দ্বিতীয় শিকার তিনি হন ৭ বলে ৭ করে। ধীরেসুস্থে এগোতে থাকা নুরুল হাসান সোহান রানআউট হন আরিফুল হকের থ্রোতে। তার সংগ্রহ ১৩ বলে ১৪। তখন বরিশালের রান ছিল ১৩৩। স্কোরবোর্ডে আর মাত্র ৩ রান যোগ হতেই সাজঘরের পথ ধরেন ডোয়াইন ব্রাভো ও নাজমুল হোসেন শান্ত। ১৮তম ওভারে ব্রাভোকে এলবিডব্লিউ করেন নারাইন। পরের ওভারে শান্তকেও একই কায়দায় ফেরান ছন্দ খুঁজে পাওয়া মোস্তাফিজ। এরপর শেষ ওভারে মঞ্চস্থ হয় দারুণ এক নাটক।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

এর আগে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা কুমিল্লা লড়াইয়ের পুঁজি পায় নারাইন ও মঈনের ব্যাটে। আগের ম্যাচের মতো ফাইনালেও ক্যারিবিয়ান নারাইন তাণ্ডব চালিয়ে করেন ২৩ বলে ৫৭ রান। ছয়ে নামা মঈনের ব্যাট থেকে আসে ৩২ বলে ৩৮ রান। ভালো শুরুর পর ২৬ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে ফেলেছিল কুমিল্লা। সপ্তম উইকেটে আবু হায়দারের সঙ্গে মঈন গড়েন ৫১ বলে ৫৩ রানের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জুটি।

অবধারিতভাবে ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে নারাইনের হাতে। বরিশালের বোলারদের কচুকাটা করার পর বল হাতেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। ৪ ওভারে মাত্র ১৫ রান খরচায় ২ উইকেট নেন তিনি।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স: ২০ ওভারে ১৫১/৯ (নারাইন ৫৭, লিটন ৪, জয় ৮, ডু প্লেসি ৪, ইমরুল ১২, মঈন ৩৮, আরিফুল ০, আবু হায়দার ১৯, শহিদুল ০, তানভির ০*, মোস্তাফিজ ০*; মুজিব ২/২৭, শফিকুল ২/৩১, সাকিব ১/৩০, ব্রাভো ১/২৬, রানা ১/৩৪)

ফরচুন বরিশাল: ২০ ওভারে ১৫০/৮ (মুনিম ০, গেইল ৩৩, সৈকত ৫৮, নুরুল ১৪, সাকিব ৭, শান্ত ১২, ব্রাভো ১, হৃদয় ৯*, মুজিব ৪; মোস্তাফিজ ১/৩০,শহিদুল ১/৩৬, নারাইন ২/১৫, মঈন ০/২৮, আবু হায়দার ০/১৪, তানভীর ২/২৫)

ফল: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ১ রানে জয়ী।

ম্যাচসেরা: সুনীল নারাইন।

টুর্নামেন্টসেরা: সাকিব আল হাসান।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

7h ago