ঐতিহাসিক জয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন সূর্যোদয়

Ebadat Hossain
৪৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের নায়ক ইবাদত হোসেন। ছবি: টুইটার

ইবাদত হোসেন যখন রস টেইলরের স্টাম্প উড়িয়ে দেন বাংলাদেশে তখনো ভোরের আলো ফুটেনি, কিন্তু ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে মাউন্ট মাঙ্গানুইর আলোতেই যেন ঝমমল করছিল গোটা বাংলাদেশ।  মুশফিকুর রহিমের  ব্যাটে যখন ম্যাচ জেতানো রান এলো তখন সূর্য উঁকি দিয়েছে শীতের সকালে। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও যেন উঠেছে নতুন দিনের সূর্য।

চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সে টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাঠে ৮ উইকেটে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের পর ঘরের মাঠে কোন প্রতিপক্ষ টেস্টে হারাতে পারল কিউইদের। বুধবার মাউন্ট মাঙ্গানুইতে প্রথম টেস্ট জিতে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে এগিয়ে এল টাইগাররা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আসরেও বাংলাদেশ পেল প্রথম জয়ের দেখা। 

সকালে প্রথম ঘন্টাতেই নিউজিল্যান্ডকে ১৬৯ রানে গুটিয়ে ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ করে রাখেন ইবাদত-তাসকিনরা। ৪০ রানের লক্ষ্য পেরুতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সাদমান ইসলাম ৩ ও ৩ চারে নাজমুল হোসেন শান্ত ফেরেন ১৭ রান করে। আর কোন বিপর্যয় ছাড়া ১৬.৫ ওভারেই কাজ সেরে ফেলে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। 

নিশ্চিতভাবেই এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন। এবং তা এলো দেশের ক্রিকেটে সিনিয়র ক্রিকেটারদের অবদান ছাড়াই। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ছিলেন না। মাহমুদউল্লাহ তো অবসরেই। সিনিয়রদের মধ্যে ছিলেন কেবল মুশফিকুর রহিম। কিন্তু এই ম্যাচে তার অবদান কেবল ১২ রান ও ৩* রান।

আগের দিনের ৫ উইকেটে ১৪৭ রান নিয়ে নেমে বাংলাদেশের পেসারদের সামনে ১০ ওভারের একটু বেশি টিকতে পেরেছে নিউজিল্যান্ড। শেষ দিনে ইতিহাস গড়ার কাজটা তাই হয়ে গেছে খুব দ্রুতই।

বাংলাদেশের এমন ঐতিহাসিক জয়ের পরিস্থিতি এসেছে সম্মিলিত প্রয়াসে। প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হক, লিটন দাস, মাহমুদুল হাসান জয় আর নাজমুল হোসেন শান্তর ব্যাট ছিল দুর্বার। বল হাতে শরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজরা এর আগেই দেখিয়েছিলেন মুন্সিয়ানা।

তবে বল হতে দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন ইবাদত। ডানহাতি এই পেসার টেস্টে তার সাদামাটা তকমা ঝেড়ে হয়ে উঠলেন বিধ্বংসী।

ইনস্যুইং, আউটস্যুইং, রিভার্স, গতি মিলিয়ে মেলে ধরেন পেসের ঝাঁজ। চতুর্থ দিনেই দারুণ এক স্পেলে ৩ উইকেট তুলে জেতার রাস্তা করে দিয়েছিলেন তিনি। ইবাদত শেষ পর্যন্ত ৪৬ রানে নিলেন ৬ উইকেট। ২০১৩ সালের পর কোন বাংলাদেশি পেসার পেলেন টেস্টে ৫ উইকেটের দেখা। শেষ পর্যন্ত ইবাদতের ফিগার ২১-৬-৪৬-৬!

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওদের মাঠে এর আগে তিন সংস্করণ ৩২ ম্যাচ খেলেও জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। সবচেয়ে করুণ অবস্থা ছিল টেস্টেই। সম্ভাবনার বিচারে ওদের মাঠে টেস্ট জেতাও ছিল সবচেয়ে পেছনের কাতারে।

প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে সেই কাজটাই হয়ে গেল সবার আগে। বাংলাদেশের এই অর্জনের মাহাত্ম বোঝাতে পারে একটি তথ্য। গত ১০ বছরে উপমহাদেশের কোন দলই নিউজিল্যান্ডের মাঠে টেস্ট জেতেনি। পাকিস্তান সর্বশেষ জিতেছিল ২০১১ সালে, ভারত ২০০৯ সালে আর শ্রীলঙ্কা শেষবার নিউজিল্যান্ড জিতেছিল ২০০৬ সালে। আরেকটি তথ্য বোঝাবে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের অজেয় চেহারা। ২০১৭ সালের পর ঘরের মাঠে কোন টেস্টই হারেনি নিউজিল্যান্ড। এই সময়ে জিতেছে টানা ৮টি টেসয় সিরিজ।  প্রতিপক্ষের সেই দুর্গেই জয় বের করে ফেললেন মুমিনুলরা।

অথচ নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলতে যাওয়ার আগে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাজেভাবে হেরে যাওয়ার গ্লানি সঙ্গী ছিল বাংলাদেশের। সঙ্গী ছিল তীব্র সমালোচনার ধকল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে শুরু হওয়া বাজে সময়ে দেশের ক্রিকেট ছিল বিষাক্ত হাওয়ায় ভরপুর। সব কিছুই আপাতত সরিয়ে দিল এই জয়।

জেতার পরিস্থিতি তৈরি ছিল আগের দিনেই। তবে পরিস্থিতি তৈরি করেও পথ হারানোর অনেক নজির আছে বাংলাদেশের। এবার তেমন কোন শঙ্কাই জাগেনি। শেষ দিনের একদম দ্বিতীয় ওভারেই বল হাতে নিয়ে ইবাদত আনেন সাফল্য। শুরুতেই সরিয়ে দেন পথের সবচেয়ে বড় কাটা রস টেইলরকে।

ইবাদতের ভেতরে ঢোকা দারুণ এক ডেলিভারিতে স্টাম্প খোয়ান টেইলর। ৯ বছর ও ৪৮ টেস্ট পর বাংলাদেশের কোন পেসার টেস্টে পান ৫ উইকেটের স্বাদ। পরের ওভারে শিকার ধরেন কাইল জেমিসনকেও।

ইবাদতের বলে ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন জেমিসন। মিড উইকেটে দুর্দান্ত এক ক্যাচ হাতে জমান শরিফুল ইসলাম। সকাল বেলাতেই ইবাদতের জোড়া শিকার দেখে জ্বলে উঠেন তাসকিন আহমেদও। তার অফ স্টাম্পের বাইরে প্রলুব্ধ ডেলিভারিতে ড্রাইভ করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হয়ে ফেরেন রাচিন রবীন্দ্র।তাসকিন তার পরের ওভারে রিভার্স স্যুয়িংয়ে বোল্ড করে দেন টিম সাউদিকে।

শেষ উইকেটটি ছাঁটেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে তাতে বড় অবদান বদলি ফিল্ডার তাইজুল ইসলামের। মিরাজের বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়েছিলেন টেন্ট বোল্ট। ডিপ মিড উইকেটে অসাধারণ এক ক্যাচ মুঠোয় জমান তাইজুল। শেষ হয়ে যায় নিউজিল্যান্ডের ইনিংস।

 

বাংলাদেশের কাজটা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিকতা সারার। সেই পথে নেমে চোটে পড়া নিয়মিত ওপেনারের জায়গায় সাদমান ইসলামের সঙ্গে ওপেন করতে আসেন শান্ত। 

সাদমান ৩ রান করে দ্বিতীয় ওভারেই ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। পরে অধিনায়ক মুমিনুলকে নিয়ে কাজ সারতে থাকেন শান্ত। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও তিনি ছিলেন চনমনে। ৩ চারে দলকে একদম জেতার কাছে নিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে থামেন শান্ত। 

জয়ের জন্য ৬ রানের প্রয়োজনে নেমে মুমিনুলের সঙ্গে কাজ সেরে ফেরেন মুশফিক।

এর আগে বাংলাদেশের এই অর্জনের ভিত্তি তৈরি করে প্রথম ইনিংস। নিউজিল্যান্ডকে ৩২৮ রানে আটকে দিয়ে ১৭৬ ওভার ব্যাট করে সফরকারীরা। 

একের পর এক জুটি, পরিস্থিতি দাবি মেনে চোয়লবদ্ধ দৃঢ়তা দেখান ব্যাটসম্যানরা। তরুণ জয় কেবল দ্বিতীয় টেস্টে নেমেই করেন ৭৮ রান, খেলেন ২২৪ বল। শান্ত টোন সেট করে দিয়ে করেন ৬৪ রান। 

অধিনায়ক মুমিনুল দেখান দৃঢ়তা, সেঞ্চুরি হাতছাড়া করলেও তার ৮৮ রানের ইনিংস দলকে দেয় শক্ত অবস্থান। লিটন দাস ছিলেন নান্দনিকতার ছবি। দৃষ্টিনন্দন সব শটে বাংলাদেশকে নিয়ে যান বড় জায়গায়। ৮৬ করা লিটনও সেঞ্চুরি হাতছাড়ার আক্ষেপে পুড়েছেন। তবে তার অবদানে দল পায় জুতসই অবস্থান। 

 

সংক্ষিপ্ত স্কোর

নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ৩২৮

বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ১৭৬.২  ৪৫৮  (সাদমান ২২, জয় ৭৮, শান্ত ৬৪, মুমিনুল ৮৮  মুশফিক ১২, লিটন ৮৬, ইয়াসির ২৬ , মিরাজ ৪৭, তাসকিন ৫, শরিফুল ৭, ইবাদত ০* ; সাউদি  ২/১১৪, বোল্ট ৪/৮৫, জেমিসন ১/৭৮, ওয়েগনার  ৩/১০১, রবীন্দ্র ০/৬৭)

নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস: ৭৩.৪ ওভারে ১৬৯  (ল্যাথাম ১৪, ইয়ং ৬৯, কনওয়ে ১৩, টেইলর ৪০, নিকোলস ০, ব্ল্যান্ডেল ০, রবীন্দ্র ১৬, জেমিসন ০, সাউদি ০, ওয়েগনার ০*, বোল্ট ৮  ; তাসকিন ৩/৩৬, শরিফুল ০/৩০,  মিরাজ ১/৪৩, ইবাদত ৬/৪৬, মুমিনুল ০/৭)

বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস (লক্ষ্য ৪০): ১৬.৫ ওভারে ৪২/২  (সাদমান ৩, শান্ত ১৭, মুমিনুল ১৩*, মুশফিক ৫* ; বোল্ট ০/৪, সাউদি ১/২১, জেমিসন ১/১২, ওয়েগনার ০/৪) 

ফল: বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী।

Comments

The Daily Star  | English

10 ministries brace for budget cuts

The railway ministry, the power division, and the primary and mass education ministry will see the biggest chop.

10h ago