মাহমুদউল্লাহর এক ‘অদ্ভুতুড়ে’ অবসর
কোন খেলোয়াড় আকস্মিক অবসর নিলেও থাকে ঘটা করে কিছু আয়োজন। গণমাধ্যমে হাজির হয়ে থাকে ব্যাখ্যা, ভক্ত সমর্থকদের কাছে থাকে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারও। মাহমুদউল্লাহ টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন এটা নিশ্চিত হওয়া গেলেও তার নিজের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। আবার বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পুরো ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে গেলেন। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক মুমিনুল হকও এই ব্যাপারে বিশদ মন্তব্য করতে রাজী হলেন না!
রোববার হারারে টেস্টের শেষ দিনের খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটারের সারিবদ্ধভাবে দুই লাইনে দাঁড়িয়ে যান। তার মাঝ দিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন মাহমুদউল্লাহ। অর্থাৎ এই ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় টেস্ট ক্রিকেটে এটা তার শেষ দিন। পরে ধারাভাষ্যকাররাও অবসরের কথা জানান।
এছাড়া নিশ্চিত হওয়ার আর কোন উপায় ছিল না। কারণ অবসর নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে সূত্রের বরাতে খবর বেরিয়ে পড়ার পর মাহমুদউল্লাহ নিজে থাকলেন আশ্চর্য রকমের নীরব। হারারে টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শেষে গণমাধ্যমের পাঠানো তার ভিডিওতে অবসর নিয়ে কোন কথাই থাকল না। ম্যাচ শেষেও কথা বলতে হাজির হলেন না গণমাধ্যমের সামনে।
যোগাযোগ করা হলে বিসিবি সভাপতি বারবার জানালেন নিজের বিস্ময়। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ আসলেই অবসরে যাচ্ছেন কিনা তা স্পষ্ট করতে যেন নারাজ সব পক্ষ।
বাজে ফর্মের কারণে গত বছর টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলেন অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। কোচ রাসেল ডমিঙ্গো জানিয়েছিলেন, পরীক্ষা দিয়েই ফিরতে হবে। কিন্তু দীর্ঘ পরিসরে কোন রকমের পরীক্ষা ছাড়াই ১৭ মাস পর নাটকীয়ভাবে দলে নেওয়া হয় তাকে। ফেরার ম্যাচে খেলানো হয় আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে। সেখানে দলের বিপদে ১৫০ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলার পর তার ক্যারিয়ারের নতুন জন্মের আভাসই মিলছিল। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ নিজেই সেই সম্ভাবনা নিভিয়ে দিলেন। এবং সেটাও কী নাটকীয়ভাবে!
এই ব্যাপারে দ্য ডেইলি স্টারকে বিসিবি প্রধান নাজমুল জানান, মাহমুদউল্লাহর অবসর নেওয়ার খবর জানতে পেরে তিনি বিস্মিত। কারণ জিম্বাবুয়ে যাওয়ার আগেও সব সংস্করণে খেলার কথা বোর্ডকে জানিয়েছিলেন তিনি। চুক্তির কাগজেও সব সংস্করণ খেলার ব্যাপারে সই করেছিলেন।
বোর্ড প্রধান বলেন, ‘এটা তো কোন সিষ্টেম হতে পারে না। একটা খেলার মাঝখানে বলছে আর খেলবে না। কী বলব বলেন। লিখিত দিল খেলতে চায়। এরপরও যদি এরকম করে! এতে তো দলের উপর প্রভাব পড়ে।’
কোচের কথায় রাগ করেই অবসর নিয়েছেন এমন কিছু খবর সম্পর্কে বোর্ড সভাপতি বলেন, কোচের আগ্রহ থাকলেও দুটি সিরিজে নিজে থেকে খেলেননি তিনি, ‘কোচ তো কখনই ওকে বাদ দিতে চায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলার সময় ওকে বলা হলো ও বলল ইনজুরড খেলবে না, আসলেই চোট ছিল কিছু। আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে আমি নিজে বললাম যাও খেল, গেল না।’
অধিনায়ক মুমিনুলের কাছ থেকে মাহমুদউল্লাহর অবসরের ইচ্ছার কথা জানতে পারেন বিসিবি সভাপতি। পরে মাহমুদউল্লাহ নিজেও তাকে ফোনে জানিয়েছেন, ‘আমাকে মুমিনুল বলেছে এরকম রিয়াদ ভাই তো অবসর নিচ্ছে বলেছে। পরে ও আমাকে ফোন করল, আমি বললাম “সিরিজটা শেষ হোক, দেশ আস। খেলতে না চাইলে সমস্যা নাই। কিন্তু লিখিত একটা চিঠি দাও।”’
কিন্তু শেষ দিনের খেলার আগের রাতে মাহমুদউল্লাহ বোর্ড প্রধানকে ক্ষুদে বার্তায় নিজের বিদায়ের কথা আরও একবার জানিয়ে দেন।
হারারে টেস্টে অপরাজিত ১৫০ রান করায় ম্যাচ সেরাও হন ৩৫ পেরুনো এই ক্রিকেটার। ম্যাচ শেষের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও বিদায় নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুমিনুলের কাছেও যায় মাহমুদউল্লাহর অবসর নিয়ে প্রশ্ন, বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক নানানভাবে এড়িয়ে যেতে চাইলেন তা, ‘এটা উনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এটা সম্পর্কে আমার কোন কিছু বলাটা কঠিন, এরকমভাবে আমি অবগত না। এটা যার যার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হতেই পারে।’
এক যুগের টেস্ট ক্যারিয়ার করা ক্রিকেটারের জন্য বিশেষ কিছু করতে চেয়েছেন কিনা প্রশ্নেও কেমন যেন অস্পষ্টতার সুর মুমিনুলের, ‘উনার যদি শেষ হয় চেষ্টা করছি উনার জন্য ডেডিকেট করে... যেহেতু শুনলাম উনার অভিষেক টেস্টেও বাংলাদেশ জিতেছিল, শেষ ম্যাচটাও জিতছে। যদি ওইভাবে হয়...আমি জানি না।’
তৃতীয় দিনের খেলার পর ড্রেসিংরুমেই প্রথম সতীর্থদের বিদায়ের কথা জানান মাহমুদউল্লাহ। আকস্মিক সেই সিদ্ধান্ত শোনার পর কেমন অনুভূতি হয়েছে তা জানাতেও যেন একটু দ্বিধা করলেন মুমিনুল, ‘দেখেন এই ব্যাপারে প্রথমে বললাম কোন কিছু মন্তব্য করা কঠিন। অবশ্যই তরুণ অধিনায়ক হিসেবে আমার খারাপ লাগার কথা। খারাপ না লাগলে অবশ্যই অস্বাভাবিক একটা জিনিস।’
২০০৯ সালে কিংসটনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় মাহমুদউল্লাহর। এরপর এক যুগে তিনি খেলেছেন ৫০ টেস্ট। তাতে ৩৩.৪৯ গড়ে করেছেন ২ হাজার ৯১৪ রান। আছে ৫ সেঞ্চুরি আর ১৬ ফিফটি। বল হাতে তার আছে ৪৩ উইকেট।
তার শেষটা হয়ে থাকল নাটকীয়তার চূড়ান্ত। কিংবা ছোট গল্পের মতো বলা যায়, ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ ক্যারিয়ার চালিয়ে গেলেও আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতি টেস্টে তার জায়গা থাকত কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন রাখার সুযোগ ছিল প্রবল।
Comments