'ক্রিকেট কি টাকার চেয়ে বড় নয়? দেশ কি টাকার চেয়ে বড় নয়?'
টেস্ট খেলতে মোস্তাফিজুর রহমানের অনাগ্রহের বিষয়টি নিয়ে বেজায় চটেছেন খালেদ মাহমুদ সুজন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের টিম ডিরেক্টরের মতে, সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিম-তামিম ইকবালরা কোনো একটি সংস্করণ থেকে বিশ্রাম পাওয়ার যোগ্য। কারণ তারা লম্বা সময় ধরে দলকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই তালিকায় মোস্তাফিজের থাকাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না সুজনের কাছে। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ক্রিকেট বড় নাকি টাকা এবং দেশ বড় নাকি টাকা?
বাংলাদেশের সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট সিরিজে চোটে ছিলেন তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। ফলে পেস বিভাগে তৈরি হয় ঘাটতি। তখন থেকেই শুরু হয় মোস্তাফিজকে টেস্টে খেলানো নিয়ে আলোচনা। তবে ওই সিরিজে তাকে পাওয়া যায়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আসন্ন দুই টেস্টের সিরিজের বাংলাদেশ দলেও নেই মোস্তাফিজ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অনুমতি নিয়েই দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন আইপিএলে।
সাদা ও লাল বলের জন্য বিসিবি আলাদা কেন্দ্রীয় চুক্তি চালু করার পর থেকে এই দুই বছরে লাল বলের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি মোস্তাফিজ। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগী হতে টেস্ট খেলতে না চাওয়ার বিষয়টি তার কথায় স্পষ্ট। চুক্তি করার ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা জানিয়েছে বিসিবি ও বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। তবে শনিবার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মাহমুদ যা বলেছেন, তা বিস্ময় জাগাতে বাধ্য। তার দাবি, কেবল সিনিয়র ক্রিকেটারদেরই সুযোগ রয়েছে কোনো সংস্করণে খেলা বা না খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার মাহমুদ বলেছেন, 'পাপন ভাই বলেছিলেন, খেলোয়াড়রা যে সংস্করণে খেলতে চায়, এ নিয়ে আলাপ করতে পারে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে কথাটা বলেছেন, সবার ক্ষেত্রে না। এখন যদি জয় বলে আমি ওয়ানডে খেলব আর টেস্ট খেলব না, এটা কি ঠিক হল নাকি? মোস্তাফিজের আসলে বয়স কত? কয়দিন ধরে খেলে? ও তো সাকিব না, তামিম না, মাশরাফি বা মুশফিক না, যারা এত বছর ধরে বাংলাদেশকে তিন সংস্করণে সার্ভিস দিয়েছে। দেশের জন্য খেলা জরুরি। আর টেস্টের মত বুনিয়াদি ক্রিকেট তো আর কিছুই হতে পারে না। আলোর ঝলকানি, টাকা-পয়সা হয়তো সাদা বলের ক্রিকেটে বেশি। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেট তো বনেদি খেলা। ক্রিকেট শুরু হয়েছে টেস্ট দিয়ে। মোস্তাফিজ কেন খেলতে চায় না আমি জানি না। এটা বোর্ডই নির্ধারণ করবে, কাকে কোথায় খেলতে হবে। আপনি কি অফিসে বলতে পারেন, আমি এই কাজ করব না, ঐ কাজ করব? আপনি এখানে কর্মী, আপনি কীভাবে বেছে নেবেন? সভাপতি বলেছিলেন সিনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যাপারে।'
তার মতে, সাদা বলের মতো টেস্টে লাল বলেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন মোস্তাফিজ, 'আমি তো চাই মোস্তাফিজ টেস্ট খেলুক। কেন না? আমাদের তো এত বোলার নেই। হাতে গুণলে ইবাদত, তাসকিন, শরিফুল, খালেদ, রাহী... এরপর বোলার কই? বাংলাদেশের সেরা ফাস্ট বোলারই তো মোস্তাফিজ। অভিজ্ঞতা বলুন, নৈপুণ্য বলুন, টেকনিক-ট্যাকটিক্স বলুন, এসব দিক থেকে তো মোস্তাফিজই সেরা। আজ তাসকিন চোটে। আমাদের মূল বোলারদের একজন খেলতে পারবে না। মোস্তাফিজ থাকলে দলের ভারসাম্য ঠিক থাকত। শরিফুলও যেকোনো সময় চোটে পড়তে পারে। তাসকিন ও শরিফুল এমন খেলোয়াড়, যারা যেকোনো সময় চোটে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে মোস্তাফিজ থাকলে আমরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলাতে পারতাম। এখন এত খেলা, তিন সংস্করণে খেলা কঠিন। এখানে সবাইকে বিশ্রাম দিতে হবে। তাসকিনের যেমন বিরতি দরকার, শরিফুলেরও বিরতি দরকার। ইবাদত-খালেদ না হয় শুধু টেস্ট খেলে, অন্য সংস্করণে খেলে না। মোস্তাফিজকে এখানে সাহায্য করার জন্য হলেও রাখা উচিৎ। বোলার যখন তৈরি হয়ে যাবে, তখন হয়ত মোস্তাফিজকে প্রয়োজন হবে না। আমি এটা জানি, সাদা বলে মোস্তাফিজ ভয়ঙ্কর। কিন্তু এটাও জানি, লাল বলেও সে প্রতিপক্ষের কাছে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।'
মোস্তাফিজের অবশ্যই টেস্ট খেলা উচিৎ বলে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন মাহমুদ, 'সাকিব-তামিমদের বয়স ৩৪-৩৫। তাদের এখন বিরতি প্রয়োজন, তারা এটার যোগ্য। কিন্তু লিটন দাস তো বিশ্রামের যোগ্য না। লিটন যদি সাকিব-তামিম হতো, বলতাম সেও বিশ্রামের যোগ্য। মোস্তাফিজের অবশ্যই টেস্ট খেলা উচিৎ। এখন তার সেরা সময়। আমরা তো বলছি না সব টেস্ট খেলো। আমি চাই, বছরে ৬-৮টা টেস্ট খেলা উচিৎ। সেটা করলে আমরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলাতে পারব। আমাদের ১২ জনের একটা ফাস্ট বোলারদের পুল দরকার, যারা তিন সংস্করণেই পারফর্ম করতে পারবে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তানের মতো এত ফাস্ট বোলার বাংলাদেশের নেই। ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করার মতো আমাদের চার-পাঁচটা ছেলেই আছে। টেস্ট ম্যাচে ১২৫-১৩০ কিলোমিটার গতি দিয়ে পারবেন না। টেস্ট জিততে হলে ১৪০+ কিলোমিটারের বোলার দিয়েই জিততে হবে। এজন্যই আমি মনে করি, মোস্তাফিজের খেলা উচিৎ। এক সময় শুনেছিলাম, বায়ো বাবলের কারণে খেলতে চায় না। তবে আমার মনে হয় না এগুলো কোনো অজুহাত হতে পারে। তাসকিন, শরিফুলরা খেলতে পারলে, তারও খেলা উচিৎ।'
মাহমুদের দাবি, মোস্তাফিজের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি শোভা পায় না, 'টি-টোয়েন্টি এমন একটা খেলা... এখানে কী পাবেন আসলে? ৪ ওভারে ৪০ রান দিবেন একদিন, ৪ ওভারে ২০ রান দিয়ে একদিন ৩ উইকেট পাবেন... টেস্ট দিয়েই তো ক্রিকেট শুরু হয়েছে। এখানে বাকবিতণ্ডার কিছু নেই। তবে আমার মনে হয় না খেলোয়াড়রা বলবে এই সংস্করণ খেলব, এই সংস্করণে খেলব না। আপনি তামিম-সাকিব হলে বিষয়টা শোভা পায়। মোস্তাফিজের এটা বলা শোভা পায় না।'
চোটপ্রবণ হওয়ায় মোস্তাফিজকে টেস্টে খুব কমই বিবেচনা করা হয়েছে। তবে আইপিএলের ওয়ার্কলোড টেস্টের চেয়ে কম না বলে মনে করছেন মাহমুদ, 'আইপিএলে কয়টা ম্যাচ খেলেন? ৬টাই ধরলাম। খালেদ, ইবাদত, তাসকিন, শরিফুল দুই টেস্টের চার ইনিংসে হয়তো ৬০ ওভার করে বল করে। ওয়ার্কলোড তো একই হচ্ছে! আপনি কোথায় বেশি ওয়ার্কলোড নিচ্ছেন? আপনি তো আইপিএলই বেশি খেলেন, আর তো কিছু বেশি খেলেন না। যুক্তির কথায় যদি আসি, ওয়ার্কলোড কোথায় বেশি আসে? আপনি আইপিএল খেলতে যাবেন, যেটা আমাদের ক্রিকেটের জন্য কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আপনি বিসিবির অধীনে খেলেন, দেশের খেলায় মনোযোগ দিতে হবে। আমি মনে করি, মোস্তাফিজ বুঝবে। ওকে আমাদের দরকার। এ মুহূর্তে ওকে খুবই প্রয়োজন।'
আইপিএল-দেশ-টাকা মিলিয়ে পুরনো বিতর্ক উসকে দিয়ে তিনি বলেছেন, 'সাদা বলে হয়তো টাকার ব্যাপারটা বেশি। আইপিএল খেললে হয়তো ২-৪ কোটি টাকা পায়। ক্রিকেট কি টাকার চেয়ে বড় নয়? দেশ কি টাকার চেয়ে বড় নয়? আমরা তো টাকার জন্য খেলিনি। (আগের যুগের) একজন ক্রিকেটারের এখন মৃত্যুর সময় বিসিবির সহায়তা লাগে। ওদের (মোস্তাফিজদের) তো লাগবে না। ওরা বরং অন্যদের সহায়তা করতে পারে। দেশের জন্য কেন আমি খেলব না?'
তবে এখনই নয়, মোস্তাফিজকে আগামী জুন-জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্টে দেখতে চাইছেন মাহমুদ, 'যেহেতু ওকে আমরা ছুটি দিয়ে দিয়েছি, আইপিএল খেলছে, এখন ওকে ডিস্টার্ব করতে চাই না। আইপিএল খেলুক। আইপিএলে আমাদের একজন প্রতিনিধিত্ব করছে, এটা আমাদের জন্য বড় একটা ব্যাপার। আমরা চাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে একটা টেস্ট হলেও খেলুক।'
Comments