চট্টগ্রাম বন্দর: এনবিআরের সার্ভারে ঢুকে ভুতুড়ে রপ্তানি

সাইবার অপরাধীরা 'সুরক্ষিত' এনবিআর সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ভুয়া রপ্তানি দেখিয়েছে।

যে ধরনের পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়েছে তাতে সরকার ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়, যার মূল্যমান আনুমানিক ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।  

প্রতারকরা ২ জন শুল্ক কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সার্ভারে প্রবেশ করে এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এমন ২৪টি রপ্তানি চালানের ভুয়া রেকর্ড তৈরি করে, যা বাস্তবে ঘটেনি।

এনবিআর সার্ভারের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে চালানগুলো 'রপ্তানি' করা হয়েছিল।

গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ (সিএইচসি) ২য় বারের মত জানতে পেরেছে, প্রতারকরা তাদের কর্মকর্তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করেছে।

সবশেষ ঘটনায় কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান সরকার ও শাহ আলম সরকারের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কারসাজি করা হয়েছে।

মাহবুবুর রহমান সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'কখনো কখনো আমি লগইন করে (সিস্টেমে) একজনকে (যিনি কাস্টমসের কর্মী নন) সার্ভারে তথ্য হালনাগাদ করতে বলেছি। ধারণা করছি সেই ব্যক্তিই এটা করেছে। আমি জানি, ইউজার আইডি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। কিন্তু কখনো কখনো ডিপোতে কাজের চাপ অনেক বেশি থাকে এবং আমাকে এরকম করতে হয় (অননুমোদিত ব্যক্তিকে সিস্টেম ব্যবহার করতে দেওয়া)।'

এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহারে আরও বেশি সতর্ক হতে নির্দেশ দিয়েছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, এমন নোটিশ এবারই প্রথম নয়।

আরেক রাজস্ব কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, 'আমি আমার অ্যাকাউন্ট অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করি। আমি অনুপ্রবেশের ঘটনা সম্পর্কে অবগত নই।'

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারে অনুপ্রবেশ করার জন্য 'অত্যন্ত সুরক্ষিত' অটোমেটেড সিস্টেম সফটওয়্যার 'অ্যাসাইকোডা ওয়ার্ড' ফর ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সমন্বিত শুল্ক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি ও ট্রানজিট প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হয়।

আগের অনুপ্রবেশের ঘটনায় এনবিআর ফাঁকি দেওয়া কর বাবদ কয়েক কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। সেবার প্রতারক চক্র সার্ভারে লগইন করার জন্য অন্য ২ জন কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে, যেগুলো অকার্যকর করার কথা ছিল। কেন এই অ্যাকাউন্টগুলো অকার্যকর করা হয়নি, সে ব্যাপারে শুল্ক বিভাগ তদন্ত করছে।

সবশেষ ঘটনার শুল্ক নথিতে দেখা গেছে, মাই ফুডস লিমিটেড, নাবিহা অ্যাগ্রো লিমিটেড এবং অলিভ সোর্সিং সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপে আমের জুস, ড্রাই কেক, মুড়ি, মসলা ও বিস্কুট রপ্তানি করেছে।

ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের কাছ থেকে পাওয়া লেটার অফ ক্রেডিটের (এলসি) তথ্য অনুসারে, ২৪টি ভুয়া চালানের মোট মূল্য ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

এ ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়, যার মূল্য আনুমানিক ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।  

সিএইচসির সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এ প্রণোদনা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ভুতুড়ে রপ্তানি দেখানো হয়ে থাকতে পারে। তবে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আলম ও মাহবুবুরের লগইন তথ্য ব্যবহার করে প্রতারকরা ভৌতিক চালানকে 'হলুদ' থেকে 'সবুজ' স্ট্যাটাসে উন্নীত করেন, যার অর্থ এ পণ্যের চালান নিয়ে এনবিআরের কোনো আপত্তি নেই। 'হলুদ' স্ট্যাটাস থাকার অর্থ হচ্ছে পণ্যগুলোর নিরীক্ষণ চলছে। মাহবুবুরের আইডি ব্যবহার করে ২৩টি চালানের স্ট্যাটাস বদলানো হয়।

তবে সম্প্রতি শুল্ক কর্মকর্তারা আবিষ্কার করেন, ৪২০ টন ওজনের পণ্যসহ ওই ২৩ চালান কখনোই চট্টগ্রাম বন্দরে আসেনি। অপর চালানটি একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে নিরীক্ষণের অপেক্ষায় আছে।

সহকারী কমিশনার মিজানুর জানান, তার অফিস থেকে ২টি ব্যাংককে উল্লিখিত ২৪ চালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের বিষয়ে কাজ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান বনলতার মালিক আবদুল মোমেন বলেন, 'আমি এ রপ্তানি নিয়ে কোনো কাগজ জমা দিইনি। কারণ তারা আমাদেরকে কোনো পণ্য পাঠায়নি।'

মাই ফুডসের সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রাসেল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ক্রেতা অর্ডার বাতিল করায় তার প্রতিষ্ঠান কাস্টমসকে বিল অফ এন্ট্রি স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছে।

তিনি জানান, কেন এনবিআরের সার্ভারে এ চালানগুলোর রপ্তানি সম্পন্ন দেখানো হয়েছে, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই।  

তিনি আরও জানান, এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কারণ পণ্য রপ্তানি হয়নি এবং বিদেশ থেকে ব্যাংকে কোনো টাকাও আসেনি।

২৪ চালানের মধ্যে ২২টিতেই মাই ফুডস এর নাম পাওয়া গেছে।

সিএইচসির কর্মকর্তারা জানান, তারা গত বুধবার মাই ফুডসের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন।

এ তদন্তের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা বলেন, 'শুল্ক বিভাগ থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার পর তারা অর্ডার বাতিল করার আবেদন জানায়।'

তবে যেহেতু বিষয়টি তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ মুহূর্তে এসব বিল অফ এন্ট্রি বাতিলের কোনো সুযোগ নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।

নাবিহা অ্যাগ্রো লিমিটেড ও অলিভ সোর্সিং লিমিটেডের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেয়নি।

প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়

কাস্টমস সম্প্রতি ১১টি আমদানি চালানের রেকর্ড চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর স্ট্যাটাস এনবিআর সার্ভারে পরিবর্তন করা হয়েছে। কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, এ ধরনের প্রতারণামূলক ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে ২ শুল্ক কর্মকর্তার লগইন তথ্য ব্যবহার করে ৯টি আমদানি চালান খালাস করার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে। এ ঘটনায় এনবিআরকে কয়েক কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একটি ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।

২০১৯ সালে শুল্ক গোয়েন্দারা ২০১৬ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে সংঘটিত বেশ কিছু অনুপ্রবেশের ঘটনা খুঁজে বের করে, যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বড় আকারে কর ফাঁকি দিতে পেরেছে।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

12h ago