মানব পাচার: ২১ ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত
গতকাল রোববার দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে মামলা দায়েরের দেড় বছর পরেও পাচারের শিকার ২১ জনের পরিবার কোনো প্রতিকার পায়নি। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। তদন্তকারী সংস্থাগুলো মামলা এগিয়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভাগ্য বদলের আশায় যে দশটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায়, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এ কাজটি করতে গিয়ে মানুষ সব ধরনের ঝুঁকি নিতে তৈরি থাকে। নিজের ও পরিবারের নির্ভরশীলদের অবস্থা পাল্টানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু, কাজের সন্ধানে বিদেশে যাওয়ার জন্য একজন কখন তার শেষ সম্বলটুকুও দিয়ে দেয়? আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশ প্রধানের তথ্যমতে, প্রতি বছর সাড়ে সাত লাখ বাংলাদেশি বিদেশে অভিবাসন বেছে নেয়। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা তাহলে কী?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক অভিবাসন-প্রত্যাশী দেশি ও বিদেশি পাচারকারীদের কবলে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। সম্প্রতি দেখা গেছে, পাচারকারীরা বিদেশে অভিবাসীদের জিম্মি করে রাখছে। তাদের খপ্পরে পড়ে এ দুর্ভাগা ভাগ্যান্বেষীরা শেষ পর্যন্ত সব হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক এসব চক্রের সঙ্গে স্থানীয় চক্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তারা পাচার হওয়াদের মুক্তির জন্য বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়দের কাছ থেকে অর্থ দাবি করছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, ভুক্তভোগীদের অনেকের শেষ পরিণতির কথা জানা যায় না।
অবৈধ অভিবাসন এবং মানব পাচার সবচেয়ে গুরুতর আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এবং আমাদের উন্নয়ন অগ্রাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, বিদেশের চেয়ে দেশে চাকরি পাওয়া বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে বিদেশে চাকরির জন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকিও নিতেও তৈরি থাকে। এটি বন্ধ করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যথাযথ উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
এ সমস্যাকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে কিছু বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে। প্রথমত, কেবল দরিদ্র ও নিরক্ষররাই বিদেশে কর্মসংস্থান খোঁজে- আমাদের এ ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতি বছর দেশ ছেড়ে যাওয়া সাত লাখের মতো অভিবাসীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অনেকে থাকেন। অর্থনীতি এখানে চালিকা হিসেবে কাজ করে। দেশে চাকরির জন্য যে পরিমাণ ঘুষ চাওয়া হয়, তা পছন্দের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পাচার চক্রের দাবি করা অর্থের চেয়েও বেশি।
দ্বিতীয়ত, বিষয়টির চাহিদা ও সরবরাহ- দুটি দিকই রয়েছে। এটা একটা মিথ যে বিদেশে 'ব্লু কলার জব' বা কায়িক পরিশ্রমের চাকরির চাহিদা নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে বাস্তবতা হল, অনেক দেশেই হোয়াইট কলার বা বড় চাকরির পাশাপাশি ছোট ও কম বেতনের চাকরির চাহিদা রয়েছে।
তৃতীয়ত, অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে যাওয়া বাংলাদেশিদের দিক থেকে প্রশাসনের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত নয়। তারা আমাদের নাগরিক এবং তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে—অন্তত তদন্তের স্বার্থে এবং চক্র চিহ্নিত করে তাদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে।
আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন না ঘটালে, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ালে, পাচারকারী চক্র ও তাদের বাইরের সহযোগীদের চিহ্নিত না করলে এবং পাচারকারীদের কঠোর শাস্তি না দিলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।
Comments