মানবাধিকার কমিশনকে অবশ্যই দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে
মৌলিক মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাতেই নিহিত। আমাদের সংবিধানে যা জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে লিখিত নিশ্চয়তা, আইন কিংবা আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অনুমোদনের চেয়ে মানবাধিকার আরও বিস্তৃত। এর জন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সঠিক মনোভাব ও ন্যায্য প্রয়োগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মতো দেশে আইন ও কনভেনশনগুলো প্রয়োগের চেয়ে লঙ্ঘনের বিষয়টিই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
যদিও মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের নেতাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। দেখা যায়, তারা এটা সমুন্নত রাখতে চাইছেন। কিন্তু কেবল ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে নয়, প্রশাসনের অনেকের মধ্যেও পক্ষপাত, পূর্বধারণা এবং ব্যক্তি অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এক ধরনের অভাবের কারণে বেছে বেছে মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ করা হয়। ফলে উপেক্ষিত হয় গুরুতর লঙ্ঘন।
এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত ও সব ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক নিয়োগের মাধ্যমে মানবাধিকার বিষয়ক জাতীয় পর্যবেক্ষককে অবশ্যই আরও উদার হতে হবে। যা এর গতি ও গুরুত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি এর ওপর জনগণের আস্থাও বাড়াবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) গঠন করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তিদের নিয়ে। বুধবার আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এই বিশ্বাস আবারও নিশ্চিত হয়েছে।
চেয়ারম্যানসহ মানবাধিকার কমিশন যেভাবে এর অন্যান্য সদস্য ও বিভিন্ন পদে কর্মীদের নিয়োগ দেয়, সেই প্রক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে ত্রুটি আছে। আবার এটাও সত্য যে, কমিশন তার ম্যান্ডেট পূরণে খুব কম ভূমিকা রাখতে পেরেছে। মানবাধিকার ইস্যুগুলোতে সাবধানে চলার প্রবণতা সক্রিয়তার ক্ষেত্রে সংস্থাটির সীমাবদ্ধ স্বাধীনতার দিকটাই ইঙ্গিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে কমিশনের ক্ষীণ প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হতে হয়। যা আমাদের সরকারকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
আমরা বিশ্বাস করি যে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আলোচনায় উঠে আসা পর্যবেক্ষণগুলো আমলে নেওয়ার মতো এবং এর ওপর কাজ করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্যারিস নীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রথমেই একে স্বাধীন হতে হবে। দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সাংবিধানিক একটা সংস্থা হিসেবে এটাকে আশা করা যায় না। সংস্থাটি বিশ্বাসযোগ্য লোকের নেতৃত্বে থাকার বিষয়টি মৌলিক প্রয়োজন। এ ছাড়া কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া উচিত। যাতে সংস্থাটি এর সুপারিশগুলো অব্যর্থভাবে অনুসরণ করতে পারে।
যেহেতু কমিশন থাকার একমাত্র কারণ হলো দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা, সেহেতু সেসব অধিকারের যে কোনো ধরনের লঙ্ঘণ চিহ্নিত করার ব্যাপারে কমিশনের ইচ্ছুক থাকা উচিত। আর সরকারের উচিত আইনের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওই বিষয়গুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক সংস্থার মতো আমাদের মানবাধিকার কমিশনও বহু বছর ধরে পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এটি অবশ্যই পরিবর্তন হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ভালো করবে যদি তারা আসকের পর্যবেক্ষণগুলো আমলে নেয় এবং মানবাধিকার কমিশনকে তাদের ম্যান্ডেট পূরণ করতে দেয়।
Comments