প্রণোদনা বিতরণকারীদের ঘুষ দাবি: ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে

ছবি: রাজীব রায়হান

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার তৈরি হয়েছে এবং এতে নিশ্চিতভাবেই প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব আসবে। এই পরিস্থিতিতে সরকার যখন প্রণোদনা প্রকল্পের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন ও সেবা খাতের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, তখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে উদ্যোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বিতরণকারীরা। তারা এই প্রণোদনার বিপরীতে ঘুষ চাইছেন।

করোনাভাইরাস মহামারি স্বাস্থ্য খাতের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। এরপরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ও সুদূরপ্রসারী পরিণতি এসেছে দেশের অর্থনীতির ওপর। সরকার তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধারের জন্য এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে, ৫০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তারা এই ঋণ বিতরণের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোকে যথোপযুক্ত বখশিশ বা ঘুষ দেননি।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেল (সানেম) পরিচালিত এই সমীক্ষায় জানা গেছে, ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি এখন ঋণের আবেদনপত্রের প্রসেসিং ও টাকা পাওয়ার পূর্বশর্ত হয়ে গেছে। এর সঙ্গে জড়িত আছেন ব্যাংকের কর্মচারীরা এবং ঋণের প্রসেসিং ও বণ্টন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।

মহামারিতে সার্বিকভাবে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও কিছু মানুষের জন্য সেটি আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে, যারা এই সুযোগে প্রচুর টাকা বানাচ্ছেন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে এক শ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় নেতা, যাদের তহবিল তছরুপ ও সরকারের বরাদ্দ দেওয়া ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ করার কুঅভ্যাস রয়েছে। একই সংস্কৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি ত্রাণ হিসেবে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও, যেখানে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ১২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শুধু ঘুষ দিয়ে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছে। এমনকি প্রণোদনা পায়নি এরকম ২৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানও একই অভিযোগ জানিয়েছে।

এটি অবশ্যই আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন, যেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষ ঘুষ চাওয়ার মাধ্যমে জনমানুষের দুর্বল অবস্থার সুযোগ নেয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এবং রপ্তানি করছেন না এরকম প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। তাদেরকে এই অনৈতিক, তথাকথিত জনগণের সেবকদের অন্যায্য দাবি মেনে নিতে হচ্ছে, শুধুমাত্র তাদের ব্যবসাকে সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।

উল্লেখিত বিষয়গুলোর সারমর্ম ও সারাংশ এটাই, যদি বর্তমান ধারাটি অক্ষুণ্ন থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কিছু পেতে হলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হবে, যেটি প্রকারান্তরে নিশ্চিত করবে তাদের পাওয়া সেই 'প্রণোদনা'র সুফল পরোক্ষভাবে ভোগ করছে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও, যাদের উদ্দেশ্যে এই প্যাকেজগুলো তৈরি করা হয়েছে, তারা সবাই সেটি পাবে না এবং সরকারের অত্যন্ত উপকারী ও সুপরিকল্পিত একটি উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সানেমের গবেষণায় জানা গেছে, ৬৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে তহবিল পায়নি। খুব দ্রুত সহায়তা না পেলে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, যেটি আমাদের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল আনবে না।

এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বিপদে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি উদ্যোগ অসাধু ব্যক্তিদের কারণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। প্রণোদনা বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কড়া নিরীক্ষণ, স্বচ্ছতা, সুষ্ঠু তদন্ত ও শাস্তির মাধ্যমেই কেবল এই প্রকল্পটি উপযোগিতা পেতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

No plan to lift ban on extremist groups

The interim government does not have any plan to lift the ban on extremist groups that were outlawed in recent decades.

5h ago