৫০ বছরে বাংলাদেশ: নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনার দেশ

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভ্যর্থনা জানান তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। ছবি: আর্কাইভ থেকে নেওয়া

আমি বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী বছরে এখানে ফিরে আসতে পেরে আনন্দিত। আমি আমার নতুন ও পুরানো বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে এই দেশের অর্ধ শতাব্দীর অসাধারণ সাফল্য উদযাপন করতে উন্মুখ। দুই সপ্তাহ আগে লন্ডনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০ বছর বয়সী  বাংলাদেশকে 'সুযোগ ও সম্ভাবনার দেশ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আমি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি এ বিষয়েও একমত যে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন রূপে স্থাপন ও নবায়ন করার জন্য বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী একটি উপযুক্ত সময়। আমাদের দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক আমাদের ঐতিহাসিক সংযোগের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে।

বর্তমানে উভয় দেশই দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষায় সমান অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। আমি নিশ্চিত যে আমাদের এই অংশীদারিত্ব আগামী পঞ্চাশ বছর ও তার পরবর্তী সময়ে বিকশিত হতে থাকবে।

আমি ১৯৭১ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির কথা স্মরণ না করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারি না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শের জন্য এবং সংবিধানে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের সম্মান জানাই।

আমার যতটুকু মনে পড়ে, স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছালে মানুষের উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ জানতেন এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিনি সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে স্বাগত জানান। পরবর্তীতে, আমাদের রয়্যাল এয়ার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার প্রথম অর্ধ শতাব্দীতে যা অর্জন করেছে তার ফলাফলস্বরূপ আজ সারা বিশ্ব এই দেশকে প্রশংসার চোখে দেখছে। কোভিড মহামারির আগে এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অধিকারী বাংলাদেশ। শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় অবদানকারী দেশ, বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা প্রদানকারী দেশ হিসেবে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কণ্ঠস্বরগুলির মধ্যে একটি—ঠিক যেমনটি আমরা গ্লাসগোর কপ২৬-এ দেখেছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আমি বাংলাদেশে আমার বন্ধুদের কথা শুনব, এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা আরও দৃঢ় করার জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো নির্ধারণ করব।

এই আকাঙ্ক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের জাতির পিতার গণতান্ত্রিক নীতিসহ আরও অনেক কিছু যার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন।

২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মর্যাদায় ভূষিত হবে। এই বিষয়টি আমাদের একে অপরের সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। আমাদের নতুন যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ডায়ালগের মাধ্যমে আমরা এই বিষয়টিকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে পারি।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির জন্য তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাজ্য। এবং বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারী হচ্ছে যুক্তরাজ্য। আমরা ২০২৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশকে শুল্ক-মুক্ত ও কোটা-মুক্ত প্রবেশাধিকার প্রদানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি আশা করি উভয় দিক থেকেই আরও উদ্ভাবনীমূলক বিনিয়োগ খুঁজে বের করে তাকে উৎসাহিত করা হবে।

আমি এও বিশ্বাস করি যে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও অবাধ ও ন্যায্য করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রসার অব্যাহত রাখতে পারি।

যুক্তরাজ্য অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবায় বিশ্বে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে–এই পরিষেবাগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তরুণ বাংলাদেশিদের বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা প্রদানের একটি বিশেষ সুযোগ রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করছে।

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে ও মানুষের জীবন বাঁচাতে 'কন্যাশিশুদের জন্য শিক্ষা' আমাদের একটি কার্যকর বিনিয়োগ হতে পারে। এই সপ্তাহে আমি বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের নতুন অর্থ সহায়তা ঘোষণা করব।

এই অর্থ সহায়তা বাংলাদেশের সব শিশুর, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের জন্য, শিক্ষায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে এবং এই দেশের অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সন্ত্রাস দমন, সামুদ্রিক ও বিমান চলাচলের নিরাপত্তা এবং বিশ্বজুড়ে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। আমি আনন্দিত যে যুক্তরাজ্যের নতুন এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ারের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রথমবার মোতায়েনের অংশ হিসেবে গত মাসে বাংলাদেশ সফর করেছিল যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভির বিশেষ রণতরী এইচএমএস কেন্ট।

এর পাশাপাশি আমি আনন্দিত যে, একজন সংলাপ অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশের আসন্ন সভাপতিত্বের অধীনে ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সমর্থন করতে সক্ষম হব। ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উপায়ে যেন কাজে লাগানো হয় তা নিশ্চিত করতে ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের এই অঞ্চলে সুশাসন ও সামুদ্রিক নিরাপত্তায় অবদান রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

এর পাশাপাশি, আমরা রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে আমি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। রোহিঙ্গা শিবিরে ও এর আশপাশে বসবাসকারীদের প্রতি সহিংসতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কথা শুনে আমি উদ্বিগ্ন।

আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে এমন একটি সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি যাতে রোহিঙ্গারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যেতে পারে।

আমরা যতদিন প্রয়োজন ততদিন রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব। আমরা এই মানবিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য ইতোমধ্যে ৩২০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি অর্থ সহায়তা প্রদান করেছি।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত ব্যাপারে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয়ে গত সপ্তাহে গ্লাসগোর কপ২৬ এ আমরা আগামী ছয় বছরের জন্য বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা কার্যক্রমে ১২০ মিলিয়ন পাউন্ডের নতুন তহবিল ঘোষণা করেছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষের অভিযোজন বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের প্রসার, দূষণ মোকাবিলা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই আর্থিক সহায়তা গ্লাসগোতে আমাদের অঙ্গীকারগুলিকে বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করবে৷

উল্লেখ্য, এই সবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের গভীর সম্পর্ক এবং ঐতিহাসিক সংযোগের কারণে। ৬ লাখ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি প্রবাসী সম্প্রদায়ের যুক্তরাজ্যের রাজনীতি, শিল্পকলা, রন্ধনশিল্প, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষায় প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে।

মানুষের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কই আমাদের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এবং এই সপ্তাহে আমি বাংলাদেশ সফরকালে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক উদযাপন করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

পরিশেষে, আমি বাংলাদেশের সবাইকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনেক অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি, আপনারা সবাই ব্রিট বাংলা বন্ধনের দীর্ঘায়ুর জন্য আন্তরিক শুভকামনা জানাবেন।

লর্ড তারিক আহমেদ: যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) দক্ষিণ এশিয়া, জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Iran plays down Israel's strikes, says they caused 'limited damage'

Iran on Saturday played down Israel's overnight air attack against Iranian military targets, saying it caused only limited damage, as U.S. President Joe Biden called for a halt to escalation that has raised fears of an all-out conflagration in the Middle East

3h ago