হারছে শুধু আফগান জনগণ

তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অবসান হয়েছে দেশটিতে ২০ বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তির আনুষ্ঠানিক দখলদারিত্বের। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই এই ঘটনাকে তালেবানদের কাছে মার্কিন বাহিনীর পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার একে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করছেন।
কাবুলের বিমানবন্দরে প্লেনে উঠতে আফগানদের হুড়োহুড়ি। ছবি: সংগৃহীত

তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অবসান হয়েছে দেশটিতে ২০ বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তির আনুষ্ঠানিক দখলদারিত্বের। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই এই ঘটনাকে তালেবানদের কাছে মার্কিন বাহিনীর পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার একে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করছেন।

কিন্তু, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী কি আসলেই তালেবানদের কাছে পরাজিত হয়েছে? কিংবা তালেবানরা কি আসলেই যুদ্ধে জিতে গেছে? নাকি পর্দার আড়ালে হয়েছে অন্য কোনো খেলা?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০১ সালের ডিসেম্বর। মাত্র দুই মাস আগেই নাইন-ইলেভেন হামলার ঘটনা ঘটেছে। যার সূত্র ধরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ 'অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম' অভিযান চালায় আফগানিস্তানে। ফলে সমাপ্তি হয় তালেবান শাসনের। যদিও এর আরেক ইতিহাস রয়েছে।

তালেবানদের তো সরানো হলো। কিন্তু, এরপর? দীর্ঘ দুই দশকের গৃহযুদ্ধে যে দেশটি বিপর্যস্ত, প্রশাসনিক কাঠামো সম্পূর্ণভাবে উধাও, নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি, সেই দেশটি চলবে কী করে? আর কারাই বা একে চালাবে? এগিয়ে এলেন বিশ্ব মোড়লরা। ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর তারা বৈঠক করেন জার্মানির বন নগরীর হোটেল পিটার্সবার্গে। বিদেশি মোড়লদের পাশাপাশি উপস্থিত থাকলেন আফগান নেতারাও। সই হলো এক ঐতিহাসিক চুক্তি। ইতিহাসে যেটি 'প্রথম বন অ্যাগ্রিমেন্ট' নামে পরিচিত। তালেবান বিতাড়নের এই চুক্তিতেই নিহিত থাকল তাদের পুনরুত্থানের পথ।

বন অ্যাগ্রিমেন্টের উদ্দেশ্যের মধ্যেই বলা ছিল, 'দেশটি পরিচালনার জন্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, যার অন্যতম প্রধান কাজ হবে "আফগান রাষ্ট্রের পুনর্গঠন"। ইংরেজিতে ছিল 'টু রিক্রিয়েট আফগান স্টেট'। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো চুক্তিতে 'রিবিল্ড' শব্দটি ব্যবহার না করে করা হয়েছিল 'রিক্রিয়েট'।

এরপর কেটে গেল ২০ বছর। এর মধ্যে ২০১১ মালে আবারও মোড়লরা বন নগরীতে বৈঠক করলেন। সই হলো আরও একটি দলিলে, যা 'দ্বিতীয় বন অ্যাগ্রিমেন্ট' হিসেবে পরিচিত। 'প্রথম বন অ্যাগ্রিমেন্ট'র পর গত ২০ বছরে দেশটিতে অনুষ্ঠিত হলো বেশ কয়েক দফা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন। প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বিদায় নিলেন ২০১৪ সালে। এলেন আশরাফ গানি। কিন্তু, সেই যে 'রিক্রিয়েটিং আফগান স্টেট', তা নিয়ে কেউই কিছু করলেন না।

কাবুলের এক প্রবেশ পথে তালেবান যোদ্ধাদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

আর করবেনই বা কেমন করে? প্রথম বন অ্যাগ্রিমেন্টের পর কাবুলে এক বিশাল সমাবেশ করে গঠিত হলো নতুন সরকার। কিন্তু, দীর্ঘদিনের আন্তর্ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব তো এক সভায় শেষ হওয়ার নয়। নর্দার্ন অ্যালায়েন্স আর দক্ষিণের পশতুনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েই গেল। সর্বোপরি যাদেরকে নিয়ে গঠিত হলো সরকার, তাদের প্রায় সবাই নন-স্টেট অ্যাক্টর সমর্থিত বা মনোনীত। এভাবে স্টেট অ্যাক্টর ও নন-স্টেট অ্যাক্টরদের দ্বন্দ্বে পড়ে স্টেট বিল্ডিংয়ের কাজটাই মুখ থুবড়ে পড়ল। আর নন-স্টেট অ্যাক্টরদের দিয়ে যে স্টেট বিল্ডিং হয় না, তা বলাই বাহুল্য।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই স্টেট বিল্ডিংয়ের সঙ্গে তালেবানদের পুনরুত্থানের সম্পর্ক কী? আছে, সম্পর্ক আছে। তবে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আফগান অর্থনীতির দিকে একটু দৃষ্টি ফেরানো দরকার। আফগান অর্থনীতিতে আসলে ড্রাগ ইকোনমি আর ওয়ার ইকোনমির একটা অদ্ভুত মিশ্রণ আছে। এ কথা সবাই জানে যে, আফগানিস্তান হলো বিশ্বের এক নম্বর আফিম উৎপাদনকারী দেশ। বলা হয়ে থাকে বিশ্বের মোট আফিমের ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় আফগানিস্তানে। এই আফিম মধ্য এশিয়ার দেশগুলো হয়ে চলে যায় ইউরোপে। যেখানে গিয়ে রূপ নেয় হেরোইনে।

বলাই বাহুল্য যে, হেরোইন ব্যবসার সঙ্গে রয়েছে হাজারো কোটি টাকার সম্পর্ক। কিন্তু, সাধারণ দরিদ্র কৃষক যে সেই হাজারো কোটি ডলারের ভাগ পায় না, এই সত্য বুঝতে কোনো রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। বিশ্বের বড় বড় সব ব্যবসায়ীরা আফিম উৎপাদনের জন্যে বিনিয়োগ করে আফগানিস্তানে। যা ফুলে-ফেঁপে হাজার গুণ হয়ে চলে যায় তাদের পকেটে। যথাযথ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কার্যকর থাকলে তা যে সম্ভব হবে না, এ কথা ব্যবসায়ীরা ভালোই বোঝেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অনুপস্থিতিতে তালেবানরাই হলো একমাত্র শক্তি, যাদের রয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃতি। তাই, আফিম আর হেরোইন ব্যবসাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে তালেবানদেরই দরকার।

এ ছাড়াও, দেশটিতে রয়েছে মূল্যবান খনিজ আর বনজ সম্পদের বিশাল সম্ভার। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দুর্বল থাকার কারণে এর সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র। আর এই সবের মোড়লও পশ্চিমের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারাই হেরোইন ব্যবসার মতোই খনিজ আর বনজ সম্পদের ব্যবসারও নিয়ন্ত্রক। যাদের কাছে তালেবানরা হলো অধিক উপযোগী বিকল্প।

আরও আছে। তবে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে মাস কয়েক আগের দৃশ্যপটে একবার তাকানো যাক। করোনা মহামারির সময়েও চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি আফগানিস্তান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত অ্যাম্বাসেডর সালমাই খালিলজাদ এক ঝটিকা সফরে কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেন। আপাত উদ্দেশ্য তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা। কিন্তু, এর ঠিক এক মাস পরই তালেবান মুখপাত্র শাহীন সুহেইল এক বিবৃতিতে জানান, তারা (তালেবান) প্রস্তাবিত ট্রান্সন্যাশনাল গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই প্রকল্প একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার কথা। যার ৫৪ শতাংশ শেয়ার ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক মার্কিন কোম্পানি ইউনোকোলের। শুরুতে এই প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চললেও সম্প্রতি তা অনেকটুকুই মিটে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তালেবান নেতারা। ছবি: এপি

এ ছাড়াও, রয়েছে ওয়েল পাইপ লাইনের বিষয়। তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানের আরব সাগর উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রকল্পেরও মূল বাস্তবায়নকারী হলো ইউনোকোল। এক্ষেত্রেও তালেবানদের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করা হয়ে গেছে। আর ইউনোকোল তো অনেক আগেই বলে দিয়েছিল যে, তালেবানরা ক্ষমতায় থাকলে তাদের ব্যবসা করতে সুবিধা হয়। সে কারণেই স্টেট বিল্ডিংয়ের কাজটি কখনই প্রাধান্য পায়নি। না জাতিসংঘের কাছে, না মার্কিনিদের কাছে।

এবারে আসা যাক আফগান অর্থনীতির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। সেটা হলো ওয়ার ইকোনমি। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী তালেবানদের দমনের নামে বিলিয়ন ডলারের এক সিকিউরিটি বিজনেসের জাল বিস্তার করে রেখেছে গত ২০ বছর ধরে। এক বাগরাম ঘাঁটিকে ঘিরেই বছরে হাজারো কোটি ডলারের ব্যবসা হয় বলে ধারণা। কিন্তু, সবকিছুর মতো ব্যবসারও একটা স্যাচুরেশন পয়েন্ট থাকে। যেখানে পৌঁছে গেলে ব্যবসায়ীরা পুরনো ব্যবসা গুটিয়ে নতুন ব্যবসা খোঁজে। মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা যখন বুঝেছে তাদের এই ব্যবসা থেকে ভবিষ্যৎ লাভের অঙ্ক কমে আসছে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবসা গোটানোর। আর এ কথা কে না জানে যে, অস্ত্র আর ওষুধ কোম্পানিগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন রাষ্ট্রীয় পলিসি।

এসব বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, আফগানিস্তানে যা ঘটছে, তা সমঝোতার মাধ্যমেই ঘটেছে। কেউই এখানে হারেনি। উইন-উইন খেলায় কেউ হারে না। যদি কেউ হেরে থাকে, তারা হলো ওই দেশের জনগণ। বলা চলে সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে'র আব্দুর রহমানেরা, যারা বুক উঁচিয়ে বলতে চায় 'ইনহাস্ত ওয়াতানাম'।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, আফগানিস্তান

moshtaque@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

17h ago