শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্বচ্ছভাষী গোলাম কাসেম ড্যাডি

একটি শিশু ঘুরে ঘুরে নাচছে, পরিবারের অন্যরা চারপাশে দর্শক হয়ে দেখছে। ছবিটি ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে তোলা। ছবি: গোলাম কাসেম/দৃক

তিনি জন্মেছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে। তুষার ঝড়ের মধ্যে একটা গরুর গাড়িতে আর মারা গেলেন জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডায়, বাংলাদেশের স্মরণকালে প্রবলতম শীতকালে। একা এবং শুশ্রষাহীন, ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধটি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয় আর যাদের তিনি ভালোবাসতেন সেই বাচ্চাদের মতো নবীন একটি মন নিয়ে, গোলাম কাসেম, ডাকনাম ড্যাডি, মারা গেলেন ১০৪ বছরের মিষ্টি বয়সে।

৭৩ ইন্দিরা রোডের একটা বাগানওয়ালা একতলা হলুদ বাড়িটি কেবল বাংলাদেশের প্রবীণতম আলোকচিত্রীরই নয়, একই সঙ্গে প্রথম বাঙালি মুসলমান ছোটগল্পকারেরও নিবাস ছিল। জন্ম ১৮৯৪ সালের ৫ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে, মাকে হারান জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই।

গোলাম কাসেম ড্যাডি (৫ নভেম্বর ১৮৯৪-৯ জানুয়ারি ১৯৯৮)। ছবি: শহিদুল আলম/দৃক

খালার কাছে বড় হওয়া এই তরুণ ফটোগ্রাফি শুরু করেন—যেভাবে অন্য তরুণরা অনেক কিছুই করে—এক তরুণীর মন পাওয়ার জন্য। কাসেম এই ইচ্ছা থেকে ধারাবাহিক গবেষণাতেও মন দেন, যা তিনি আমৃত্যু ধরে রেখেছিলেন। তিনি কলকাতার চৌরঙ্গির স্টুডিওগুলোতে ঘোরাঘুরি করতে থাকেন, যাতে পদ্ধতিটা জানা যায়। ফিল্মটাকে ঝলসে যাওয়া থেকে বাঁচাতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তার বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন। একটা কোয়ার্টার সাইজ এনসাইন বক্স ক্যামেরা কেনার জন্য মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন এবং যত্নের সঙ্গে ওই নেগেটিভগুলো সংরক্ষণ করতেন। তার সংগ্রহশালার স্পষ্ট হাতের লেখার চিহ্ন দেওয়া পুরনো কাগজের স্তূপের সঙ্গে রাখা আছে ১৯১৮ থেকে জমানো কাচের পাতগুলো। কলকাতার পোতাশ্রয়, প্রথম জমানার বাষ্পীয় ইঞ্জিন, শর্টস পরা গুর্খা রেজিমেন্ট এবং অসংখ্য পোর্ট্রেট। ওই সময়কার ছবিগুলোতে সেই নরম আলো পাওয়া যায় যা তখনকার স্টুডিওগুলো ব্যবহার করত। মানুষের গ্রেইনলেস সব নেগেটিভ, সাধারণত সুচিন্তিত পোজে। তার স্বতঃস্ফূর্ত ছবিগুলো ছিল জীবজন্তু আর শিশুদের এবং কিছু কিছু তারমধ্যে অমূল্য রত্ন। 'তার প্রথম নাচ' একটা অনবদ্য আলোকচিত্র, একটা শিশু ঘুরে ঘুরে নাচছে, পরিবারের অন্যরা চারপাশে দর্শক হয়ে দেখছে।

দুই মেয়ে, ভবানিপুর, দক্ষিণ কলকাতা, ভারত, ১৯২০ সাল। ছবি: গোলাম কাসেম/দৃক

তার বন্ধু একজন শিক্ষকের বলিষ্ঠ পোর্ট্রেট আর তার দাদিমার শান্ত পোর্ট্রেট দেখে মনে হয় না যে তিনি একজন শৌখিন আলোকচিত্রী ছিলেন, যিনি নিছক মজা পাবার জন্য ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন। ড্যাডি প্রথম তার ছবি বিক্রি করেছিলেন ৯৮ বছর বয়সে, দৃকের ১৯৯১ সালের ক্যালেন্ডারের জন্য। ক্যালেন্ডারটি ছিল জল নিয়ে। এর ইনার কাভারে ড্যাডির একটা ছবি ব্যবহার করা হয়। এটি ছাপা হওয়ার পর তাকে যখন সম্মানী দিতে যাই তখন তিনি হেসে বললেন, 'এটা আমার আলোকচিত্রী জীবনের প্রথম সম্মানী।'

'সেই সময়ে আলোকচিত্রীরা খুবই দুর্লভ ছিলেন। অবশ্য কিছু পেশাদার আলোকচিত্রী ছিলেন, কিন্তু তারা তাদের বিদ্যা গোপন রাখতেই পছন্দ করতেন এবং এটা অন্যদের কাছে ফাঁস করতেন না। তাই সাহায্য করার মতো কেউ ছিলেন না কিন্তু হতোদ্যম করবার জন্য অনেকেই ছিলেন। এসব সংকটের মধ্য দিয়েই আমাকে আমার শখের পথে এগোতে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, সময়ের অনেক অপচয় হয়েছে, অর্থের অপচয় হয়েছে আর শক্তির অপচয় হয়েছে। চরম হতাশা ছিল আর সঙ্গে ছিল সামান্য সাফল্য।'

ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ড্যাডি তার ইন্দিরা রোডের বাড়িতে নিয়মিত সভার আয়োজন করতেন, যেখানে ক্লাবটি স্থাপিত হয়েছিল। নিয়মিত যারা আসতেন তাদের মধ্যে ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, পটুয়া কামরুল হাসান এবং আলোকচিত্রী মনজুর আলম বেগ। তার চিঠিগুলো ছিল হাতে লেখা, প্রতিটিতে নম্বর বসানো এবং খামগুলো প্রায়ই পুরনো খবরের কাগজ বা বইয়ের মোড়ক দিয়ে বানানো। কদাচিৎ ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। যেসব আলোকচিত্রী স্থানীয় অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন না, তারা সেখানে ছবি জমা দিতেন এবং তারা মাঝেমধ্যে যা অতি সাধারণ পুরস্কার পেতেন তাতেই গর্ববোধ করতেন। পুরস্কার বিতরণীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও থাকত। অনুষ্ঠানে তাকে গান গাইতে সাধতে হতো। সাধলে তিনি না করতেন। আবার সাধতে হতো। এভাবে কয়েকবার সাধার পর তিনি রাজি হতেন এবং গাইতেন। আমাকে অনেকে বলেছেন, তাকে যদি কয়েকবার সাধার পর আরেকবার না সাধা হতো, তাহলে তিনি খুব অভিমান করতেন।

তার শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছিল ডার্করুম। লাল একটা প্লাস্টিকের বাটি একটা লাইট বাল্বের নিচে রাখা, তার সেইফ লাইট। ড্যাডি পুরনো টিনে রাখা কেমিক্যাল থেকে তার নিজের কেমিক্যাল বানাতেন। মাঝেমধ্যেই আমি এসওএস বার্তা পেতাম। সেই একই স্পষ্ট হাতের লেখা, তার সর্বশেষ গবেষণার জন্য দরকারি পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড কিংবা অন্য কোনো কেমিক্যাল চেয়ে। তার অনুরোধগুলো ছিল খুবই ছোট।

ফটোগ্রাফি ছিল তার প্যাশন। একবার বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস) এর পক্ষ থেকে তাকে একটা নতুন ক্যামেরা উপহার দেওয়া হয়েছিল। ড্যাডি বলেছিলেন, তাকে দেওয়া ক্যামেরাটি তার কাছে একটা যন্ত্রের চেয়ে ঢের বেশি কিছু। তিনি বলেছিলেন, ঘুমোতে যাবার সময় কীভাবে তিনি তার ক্যামেরাটি বালিশের পাশে রাখতেন। যখন তার মন খারাপ হতো, কেমন করে তিনি ক্যামেরাটির সঙ্গে কথা বলতেন এবং সেটাও পাল্টা কথা বলে আস্থা ফিরিয়ে দিত তাকে।

আধুনিক মোটরচালিত মডেলগুলো ড্যাডির ভালো লাগত না। তার পছন্দ ছিল সাধারণ একটা ম্যানুয়াল এসএলআর, 'খুব ভারী না হলে ভালো হয়', দুষ্টুমির হাসি হেসে যোগ করতেন। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, তিনি প্রযুক্তি সম্বন্ধে বিব্রত ছিলেন। সমস্ত ব্যাপারেই তার অসম্ভব কৌতূহল ছিল। তাকে যখন জানালাম, আমাদের ইমেইল রয়েছে, এর মাধ্যমে খুব সহজে এবং দ্রুত অনেক দূরে চিঠি পাঠানো যায়। শুনে তিনি বললেন, 'আমার এক নাতনিজামাই আছে, মেজর ইউসুফ হারুন, কানাডায় থাকে; তার সঙ্গে যদি যোগাযোগ করা যায়।' অনেক খুঁজে তার ইমেইল জোগাড় করলাম। আমার মনে পড়ে পুরু কাচের চশমাটা এঁটে কানাডাপ্রবাসী নাতনিজামাইর পাঠানো তার জীবনের প্রথম ইমেইলটি পড়েছেন। আমাকে পরের দিন যেতে বলেছিলেন এবং আমি তার গোলাপ বাগানের পাশে আমার সাইকেলটা রাখার সময়ই তিনি তার উত্তর লিখে তৈরি ছিলেন, আবারো তার সেই স্পষ্ট হাতের লেখা। আমি প্রায়ই উত্তর প্রিন্ট করে নিয়ে যেতাম। এক দিন কথা শেষ করে চলে যাচ্ছি, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ড্যাডির জানালায় তখন আলো জ্বলছে। ড্যাডি আলোর পাশে চিঠি রেখে তা মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। ইমেইল নিয়ে তিনি অভিভূত ছিলেন এবং নিয়মিত ব্যবহার করতেন আর কীভাবে বার্তা পৌঁছায় তা জানতে ভীষণ কৌতূহলী ছিলেন।

ড্যাডি প্রচণ্ডভাবে আত্মনির্ভরশীল ছিলেন। নিজের খাবার নিজে রাঁধতেন, তার কুকুর-বিড়ালগুলোকে খাওয়াতেন এবং নিজেই বাজার করতেন। একদিন নিজেই রাস্তায় নেমে এবং সিঁড়ি ভেঙে একটা দোতলা বাড়িতে যান তার এক বান্ধবীর কাছে, যাকে তিনি মাঝেমধ্যে দেখতে যেতেন। আমাকেও নিয়ে গেলেন সঙ্গে। সেখানে তার বান্ধবীর ছেলেও ছিল। তার টক-মিষ্টি লজেন্স খুব পছন্দ ছিল। যদি বলতাম আমি কিনে নিয়ে আসি; তিনি বলতেন, 'না না, আপনি বুঝবেন না।' আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে দোকানে গিয়ে লজেন্স কিনতাম।

নিজের সম্পর্কে খুব কম বলতেন। তিনি যে প্রথম বাঙালি মুসলমান ছোটগল্পকার তা আমি জানতে পারি প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে। তিনি সওগাতের জন্য নিয়মিত লিখতেন আর বিপিএস নিউজ লেটারের জন্য আলোকচিত্র বিষয়ে টেকনিক্যাল প্রবন্ধ ও সাধারণ প্রকাশনার জন্য ছোটগল্প- দুই ক্ষেত্রেই লেখালেখি চালিয়ে যান। তার সর্বশেষ পাণ্ডুলিপি সহজ আলোকচিত্রণ, আলোকচিত্রবিষয়ক একটি সাধারণ পুস্তিকা, দুঃখজনকভাবে আমার কাছে অপ্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। মারা যাওয়ার আগে তিনি ভীষণভাবে চেয়েছিলেন এটিকে ছাপার অক্ষরে দেখে যেতে। প্রুফ দেখা শেষ, ছবি বাছাইও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নানা কারণে অন্য কাজগুলো অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। বইটা ছাপার ব্যাপারে তাগাদা দিয়ে তিনি আমাকে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। জীবিত থাকতে তার হাতে বইটা তুলে দিতে পারিনি। তাই তার লেখা শেষ চিরকুটটি আমাকে চিরকাল যন্ত্রণা দিয়ে বেড়াবে।

সদা স্বচ্ছভাষী ড্যাডির শততম জন্মদিনে, দৃক গ্যালারিতে তার এবং আলোকচিত্রের আরেক গুরু মনজুর আলম বেগের 'ওল্ড ইজ গোল্ড' শিরোনামে এক যৌথ আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করি। ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধক ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। ১০৫ বছর বয়সে নাসিরউদ্দীন সাহেবের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা সম্ভব ছিল না। তাকে চেয়ারে বসিয়ে ধরাধরি করে ওপরে নিয়ে যাই। কিন্তু ড্যাডি কিছুতেই চেয়ারে বসে উঠবেন না। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড্যাডি সাবলীলভাবে বলেছিলেন, কীভাবে আলোকচিত্র পৃথিবীর মানুষের জন্য বন্ধুত্ব তৈরি করার, বাঁধা ছিন্ন করার, পরস্পরকে জানবার একটা রাস্তা। এরপর ১৯৯৬-এর ওয়ার্ল্ড প্রেসফটোর উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে শরীরের বয়স-ভারাক্রান্ত হওয়ার বাধাকে জিততে তার নিজের সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। 'আমার শরীর বলে-না, কিন্তু মন বলে তোমাকে পারতেই হবে এবং শেষ পর্যন্ত যে জেতে সে হচ্ছে মন।'

৯ জানুয়ারি ১৯৯৮, শরীরখানা শেষবারের মতো 'না' বলল এবং মনটা উড়াল দিল।

শহিদুল আলম: আলোকচিত্রী ও প্রতিষ্ঠাতা পাঠশালা- সাউথ এশিয়ান মিডিয়া একাডেমি

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

7h ago