সীমান্ত হত্যা: বিএসএফের দাবি ও বিজিবির রহস্যজনক নীরবতা

সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত ৫২তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে অনুষ্ঠিত ৫ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ, আর ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন বিএসএফ প্রধান পঙ্কজ কুমার সিং।

সম্মেলন শেষে প্রথা অনুযায়ী যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে বিএসএফ প্রধান দাবি করেন, এ যাবতকালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে যারা নিহত হয়েছেন, তারা সবাই অপরাধী। তিনি আরও দাবি করেন, যতগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সবই ঘটেছে রাতের বেলা।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যা দীর্ঘদিনের পুরনো একটি বিষয়। প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হচ্ছেন। দিনের পর দিন এই সংখ্যা বাড়ছেই। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল— এই ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন। আর এই হিসাব ২০০০ সাল থেকে ধরলে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০২০— এই ২০ বছরে ১ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে খুন হয়েছেন। এরমধ্যে ২০১১ সালে নিহত ফেলানী তো আছেনই।

এই বাস্তবতায় বিএসএফ প্রধানের বক্তব্য নিঃসন্দেহে প্রতিবাদের দাবি রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলো সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিজিবি প্রধান বিএসএফের দাবির বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। মনে হয়, তিনি এই 'অপরাধী' বিষয়টা সজ্ঞানে পাশ কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু এই আপ্তবাক্যটা কে না জানে যে নীরবতা সম্মতির লক্ষণ! তাহলে কি তিনি বিএসএফের বক্তব্যকেই মেনে নিয়েছেন বা সমর্থন করছেন? তাই যদি হয়, আমাদের সবাইকেও মেনে নিতে হবে যে বিএসএফের গুলিতে যারা মারা গেছেন, তারা সবাই অপরাধী বা ক্রিমিনাল। সেই ১১ বছর আগে বিএসএফের গুলিতে খুন হওয়া ফেলানীও একজন ক্রিমিনাল ছিলেন!

বিএসএফ প্রধানের বক্তব্য আরও প্রমাণ করে অপরাধী হলেই গুলি করে মেরে ফেলার অধিকার তারা সংরক্ষণ করে— তা অপরাধী যে দেশেরই মানুষ হোক না কেন। তবে কি অপরাধীকে প্রচলিত আইনের আওতায় নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার কোনো বিধান ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? আরও একটা কথা বলেছেন পঙ্কজ কুমার সিং— 'সব গুলির ঘটনাই ঘটেছে রাতের বেলায়'। কী চমৎকার যুক্তি! রাতের বেলায় খুন করলে সব জায়েজ? ছেলেভোলানো ছড়া-গল্পেও এমন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

প্রসঙ্গত আরও একটা বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। ভারত থেকে শুধু গরু চোরাচালানই হয় এমন নয়, ফেনসিডিল, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রও আসে বাংলাদেশে। কিন্তু, বিএসএফের চোখে পড়ে কেবল গরু কারবারিরা? মরেও তারা বেশি? মাদক ও অস্ত্র কারবারিরা বিএসএফের নজরে আসে না কেন? এর মধ্যেও কি কোনো রহস্য বা এজেন্ডা লুকিয়ে আছে?

ভারত থেকে যে গরু বাংলাদেশে আসে, সেগুলো কিন্তু আসে অনেক দূরের রাজ্য যেমন: হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ— এসব রাজ্য থেকে। এই যে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে গরুগুলো বাংলাদেশ সীমান্তে আসে, তা কি বিএসএফের চোখে পড়ে না? আসলে বিএসএফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে খোদ ভারতীয়দেরই। ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চসহ (মাসুম) অনেকেই মনে করেন বিএসএফ যখন ভাগ পায় না, তখনই গুলি করে। আর, সেই বিএসএফ প্রধানই বাংলাদেশে এসে বলে গেলেন, যাদেরকে তারা মেরেছেন, তারা সবাই অপরাধী বা ক্রিমিনাল। হায় সেলুকাস!

অস্বীকার করি না যে, বাংলাদেশ আর ভারতের মাঝে রয়েছে সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত যেভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে, তা কোনোদিনও ভোলার নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটো বন্ধুপ্রতিম দেশে সীমান্ত হত্যার মতো একটা ইস্যু থাকার কথা নয় আদৌ। কিন্তু, তা শুধু আছেই না, বরং দিনকে দিন বাড়ছে। সময় এসেছে এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করার। যদি যুক্তির খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে, যাদের খুন করা হয়েছে তারা অপরাধী ছিলেন, তাহলেও তো তাদের খুন করার কথা নয়? অপরাধ করলে বিএসএফ তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে জেলে দিতে পারত, জরিমানা করতে পারত? কিন্তু তা না করে গুলি করে মেরে ফেলার অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে?

যতটুকু জানি ভারতের বিএসএফ অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুযায়ী, পাচারকারী, চোরাকারবারি— কাউকেই একটা চড় দেওয়ার এখতিয়ারও বিএসএফের নেই। তারপরও গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। অথচ আমরা যদি ভারতের অন্য সীমান্তের দিকে তাকাই, দেখব দৃশ্যপট ভিন্ন। ভারতের সঙ্গে বৈরী চীনেরও সীমানা রয়েছে। সেখানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও গুলি ছোঁড়ার কোনো অনুমতি নেই। কে না জানে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমানা বিরোধ ২ দেশের মধ্যে কয়েকটা যুদ্ধ পর্যন্ত বাধিয়েছে। কিন্তু, পাকিস্তান সীমান্তে কোনো বেসামরিক মানুষকে গুলি করে মারার ঘটনা ঘটেনি বা ঘটে না। সব গুলির ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ সীমান্তে। বিশ্বের অনেক দেশেরই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু, ভারত-বাংলাদেশের মতো এমন বেসামরিক মানুষ খুনের ঘটনাতো ঘটে না।

প্রায় দেড় দশক আফগানিস্তানে কাজ করেছি। আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই ২ দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে গোলাগুলি হয়। কিন্তু, বেসামরিক মানুষদের এইভাবে খুনের ঘটনা তো একটাও মনে করতে পারছি না? আফগানিস্তানের সঙ্গে ইরান ও মধ্য এশিয়ার বেশ কটি দেশেরও স্থল সীমান্ত রয়েছে। সেখানেও এমন গুলি করে মানুষ মারার কোনো ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছি না।

কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কেন এমন হয়? প্রতিবছরই সীমান্ত সম্মেলনের আয়োজনের করা হয়, প্রতিবছরই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু, কাজের কাজ কিছু হয় না। মানুষ মরে, খুন হয়। বলাবাহুল্য যে অধিকাংশই বাংলাদেশের। এরপরও আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নীরব কেন? বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র দুটো দেশের সীমানা রয়েছে— ভারত ও মিয়ানমার। কিন্তু, ভৌগলিক অবস্থার কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানার প্রকৃতি ভিন্ন। সেই অর্থে একমাত্র ভারতের সঙ্গেই আমাদের কার্যকর সীমানা। এই একমাত্র প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনায় যদি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীরব থাকা হয়, তাহলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে নানাবিধ বিরূপ প্রশ্ন জাগার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

অবশ্য শুধু বিজিবিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিজিবি তো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারে না। তাই হয়তো বিএসএফের বক্তব্যকে খণ্ডন করার তেমন একটা গরজ বোধ করেনি। আসলে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে আমাদের এক ধরনের কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। আর তারই প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিজিবিসহ রাষ্ট্রের অন্যসব প্রতিষ্ঠানের ওপর। মনে পড়ে, ২০১৯ সালে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে 'স্বামী-স্ত্রীর' সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।  ২০২১ সালের নভেম্বরে লালমনিরহাট ও সিলেট সীমান্তে বিএসএফের হাতে ৪ জন বাংলাদেশি খুন হওয়ার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করলেন, 'এই ঘটনা ভারতের জন্য লজ্জার'। অথচ একই মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী দিনাজপুর সফরে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'সীমান্ত হত্যা উভয় দেশের জন্যই দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত'।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষা আর ভারতীয় কূটনীতিকের ভাষার দিকে একটু ভালো করে নজর দিলেই বোঝা যাবে কূটনীতিকের কাজই যেন ভারতকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করা। মনে হয় কোথায় যেন আমাদের মেরুদণ্ডের ভেতরের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। তাই ক্রমেই তা সামনে ঝুঁকে কুঁজো হয়ে আসছে। তা না হলে আমার বাড়িতে বেড়াতে এসে আমারই প্রতিবেশী আমার খুন হওয়া ভাই-বোনদের ভদ্রভাষায় ক্রিমিনাল বলে অপবাদ দিয়ে গেল, আর আমি নীরবে তা মেনে নিলাম? কী করে তা হয়? বিজিবির নীরবতার রহস্য কি তবে ওখানেই যে, আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ডের ক্রমহ্রাসমান  মজ্জাহীনতায়?

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Effective tariff for RMG exports to US climbs to 36.5%: BGMEA

The tariff will be a bit less if 20% of the cotton used in garment production is sourced from the USA

2h ago