সাফারি পার্ক কি নিরাপদ হতে পারে?
একের পর এক প্রাণীর নিদারুণ মৃত্যু হলো বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। প্রাণীদের হত্যার অভিযোগও করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। মিডিয়ার কলম কী ক্যামেরা থামছে না। একের পর এক প্রতিনিধি যাচ্ছেন। আলোচনা চলছে, তর্ক হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কমিটি হয়েছে, তদন্ত হচ্ছে নানারকম, বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন।
সাফারি পার্ক ঘিরে এক দফারফা কাণ্ড। এক প্রাণীর মৃত্যুর খোঁজ নিতে গিয়ে বাঘসহ আরও প্রাণীর মৃত্যুর কথাও ফাঁস হলো। সবকিছু মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে সাফারি পার্কে এতদিন প্রাণীগুলো কী অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। বন্দী এক ভয়ংকর মৃত্যুপুরী। কোনো মায়া কী একটুখানি ভালোবাসাও ছিল না প্রাণীদের প্রতি। প্রাণীগুলো অসহায়ভাবেই মৃত্যুর প্রহর গুণেছে। আর গাড়ির ভেতর থেকে আমরা সাফারি পার্ক ঘুরে এই অসহায় প্রাণীদের দেখে উৎফুল্ল হয়েছি। কী নির্মম, কী ভয়ংকর! সাফারি পার্কে আজ এত মৃত্যুর খবর প্রচারের কারণেই আমরা নড়েচড়ে বসেছি। এখন কথা হবে প্রাণীর খাদ্য, অসুখ, ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ, স্থান সংকুলান এইসব বিষয়ে। কিন্তু এসব আমরা প্রথম থেকেই কেন বিবেচনা করিনি? বন্যপ্রাণী ও বাস্তুতন্ত্র সংবেদনশীল কোনো নীতিমালা কী ব্যবস্থাপনা আমাদের ছিল কী? তাহলে এভাবে কিছু বুনো প্রাণীদের কেবলমাত্র বিনোদনের নামে একটা জায়গায় আটকে রেখে 'সাফারি পার্ক' নাম দেওয়ার মানে কী? সাফারি পার্কে তো প্রাণীরা নিরাপদ থাকবে, দর্শনার্থীদের সাথে বন্যপ্রাণীর এক ভালোবাসাময় দায়িত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। সাফারি পার্ক ভ্রমণের পর মানুষ বন্যপ্রাণীর প্রতি তার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হবে। কিন্তু তা কী হচ্ছে? আমরা কি এসব খতিয়ে দেখছি, বিশ্লেষণ করছি। সাফারি পার্ক ভ্রমণের প্রচুর ভিডিও ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে। সেসব ভিডিও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দর্শনার্থীদের ভেতর বন্যপ্রাণী সম্পর্কে একটা শ্রেণিগত বৈষম্যমূলক মনস্তত্ব তৈরি হচ্ছে। যেমন, অধিকাংশই বাঘ দেখাকেই একমাত্র শ্রেষ্ঠ সফল দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। তার মানে বাঘ ভিন্ন অপরাপর বন্যপ্রাণী বাঘের চেয়ে কম গুরুত্বের হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির কোনো বিশেষ প্রাণপ্রজাতির প্রতি বিশেষ একক মনোযোগ কিংবা শ্রেষ্ঠত্বমূলক মনস্তত্ত্ব প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য প্রাণীদের বেঁচে থাকাকে সংকটাপন্ন করে তোলে। করোনা মহামারিকালে যখন দমবন্ধ চারদিক, তখন সাফারি পার্কে এত প্রাণীর মৃত্যুর খবর আমাদের অপরাধী করে। উদ্বিগ্ন করে। কারণ করোনার মতো এক জুনোটিক বা প্রাণীবাহিত রোগ কী করতে পারে তা চলতি আমরা কমবেশি আন্দাজ করেছি। সাফারি পার্কের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কম জায়গায় অনেক প্রাণী এবং বাইরে থেকে আনা প্রাণীরা শালবনের বাস্তুতন্ত্রে খাপ খাওয়াতে পারছে না এরকম নানা আলাপ উঠছে। খুব মনে পড়ছে ২০১১ সালের কথা। যখন রাথুরা শালবনে 'বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক' গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১১ সালের ৩ মার্চ অধিগ্রহণ নোটিশ পাওয়া হাজার হাজার মানুষ গাজীপুরের শ্রীপুরের পিরুজালী-বাবুরচালাতে সমাবেশ করেছিলেন। তারা শালবনের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার কথা বলেছিলেন। সাফারি পার্কে বিদেশ থেকে প্রাণীদের না আনার আহবান জানিয়েছিলেন। আমরা মানুষের সেইসব কথা গুরুত্ব দেইনি। ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড ও মুরইছড়া ইকোপার্ক প্রকল্প উদ্বোধনের সময়ও স্থানীয় আদিবাসীরা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার প্রশ্ন তুলেছিলেন। ২০০৪ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনেও ইটের দেয়াল তুলে ইকোপার্ক প্রকল্পের বিরোধীতা করেন স্থানীয় জনগণ। সাফারিপার্কের ক্ষেত্রে বাস্তুতন্ত্র উপযোগী প্রাণীপ্রজাতি নির্বাচন, সংবেদনশীলতা, ব্যবস্থাপনা এবং প্রাণীদের বিচরণস্থল এবং পরিবেশের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্ক একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি যারা সাফারিপার্কে ঘুরতে আসবেন তাদের কাছে সামগ্রিক সফরকে প্রতিবেশীয় শিক্ষার অংশ করে তোলা জরুরি।
২.
২০১৩ ও ২০১৫ সালে দুই ধাপে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মোট ২৫টি জেব্রা আনা হয়। ২০১৫ সালেই ১১টি জেব্রার মৃত্য হয়। ২০১৭ সালে জেব্রা শাবকের জন্ম হয় এবং ২০২১ পর্যন্ত মোট ২৫টি জেব্রা শাবকের জন্ম হয়। ২০২১ পর্যন্ত নানাকারণে আরও ১০টি জেব্রা মারা যায়। ২০২২ সালের ২ থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়। সাফারি পার্ক চালুর পর জেব্রা মারা গেছে ৩২টি। ২০১৭ সালের ১৭ মে অজ্ঞাত রোগে দুটি জিরাফ মারা যায় এবং ২০১৭ সালে একটি পুরুষ জিরাফ মারা যায়। এখন পর্যন্ত পার্কে দুটি সিংহ মারা গেছে। পার্কে বেশ কয়েকটি ক্যাঙ্গারু আনা হলেও এদেরও ধারাবাহিক মৃত্যু ঘটেছে (সূত্র: ইত্তেফাক, ৭/২/২২)। ১২ জানুয়ারি একটি বাঘ মারা গেলে পার্ক কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, অ্যানথ্রাক্সে মারা গেছে। চামড়াসহ বাঘটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার কথা জানা যায়। এর আগে আরো একটি বাঘ মারা গেলে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, গলায় গুইসাপ আটকে বাঘ মারা গেছে। গণমাধ্যম সূত্র বলছে জেব্রা যেখানে বসবাস করছে সেখানে রয়েছে বিশাল শালবন, জেব্রার খাবারের অনুপযোগী উদ্ভিদ ও লতাপাতা রয়েছে এখানে, আছে বদ্ধ নালা, সেখানে পানি জমে থাকে, জেব্রার বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত এই এলাকা। ঘটনার পর স্থানীয় সাংসদ এমপি সবুজ সাফারি পার্ক পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকে জানান, পার্কের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একজন আরকেজনকে ফাঁসাতে নিজেরাই জেব্রাদের হত্যা করেছেন, ১১টি জেব্রা মারা যায়নি (সূত্র: সমকাল, ৩০/১/২২)। পরবর্তীতে সাফারি পার্ক পরিদর্শন শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং দোষীদের বিচার হবে। সাফারি পার্কে প্রাণী মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেয়ার কথাও জানা যায় (সূত্র: সমকাল, ৬/২/২২)।
৩.
সাফারি পার্কে সাম্প্রতিক প্রাণীমৃত্যুর ঘটনায় যেসব আলাপ, অভিযাগ, মতামত, তর্ক ওঠেছে তা কেবল ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কোনো বিষয় নয়। প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা এবং প্রতিবেশ-সংবেদনশীল মনস্তত্ত্বের ময়দানকেও সামনে আনে। কারণ সাফারি পার্কে কোনো প্রাণী আমরা এনেছি দায়িত্ব নিয়ে। আমরা এর খাদ্য, বিচরণ, স্বভাব, রোগবালাই, সংকট সম্পর্কে জানি এবং এর ব্যবস্থাপনা জানি বলেই। কিন্তু একের পর এক ঘটনা জানান দিচ্ছে কোনো প্রাণীদের প্রতি আমরা বিন্দুমাত্র দায়িত্বশীল আচরণ করিনি। এক একটি জীবন্ত প্রাণসত্তা কোনোভাবেই দোকানের সাজিয়ে রাখা খেলনা পুতুল নয়। এর টিকে থাকা কী পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর নানা জটিলতা থাকে। আমরা শালবন বাস্তুতন্ত্রে দেশের বাইরে থেকে জেব্রা, সিংহ কী ক্যাঙ্গারু এনে ছেড়েছি। এসব প্রাণী তো শালবনের প্রকৃতিতে তার নিজের খাদ্য কিংবা বিচরণের ক্ষেত্রে খুঁজে পাবে না। এখানকার উদ্ভিদ কী প্রাণীর সাথে বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে না। আমরা একটা শালবন বাস্তুতন্ত্রে এখানকার প্রাণপ্রজাতি সুরক্ষা ও বিকশিত না করে বাইরে থেকে প্রাণীদের আটকে রেখে তাদের বাইরের খাবারের জোগান দিচ্ছি। সেই খাবার নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, একজন আরেকজনকে ফাঁসাতে প্রাণীদের হত্যা করেছে। তার মানে এমন নির্মম ঘটনা কি কোনোভাবে ঘটতে পারে? ব্যক্তি কোন্দল, দ্বন্দ্ব বা স্বার্থের কারণে সাফারি পার্কের প্রাণীরা তাহলে নিরাপদ হবে কী করে? দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দিয়েই কী এর মোকাবিলা সম্ভব? কোন্দল বা দ্বন্দ্বের কারণে পরবর্তীতে আবারো প্রাণীদের এমন করুণ পরিণতি ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? সাফারি পার্ক প্রকল্প শুরুর দিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, মূলত নাগরিক ক্লান্তি থেকে মুক্ত হতে বিনোদনের জন্য এ পার্কটি করা হচ্ছে। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক' উদ্বোধনের জন্য ৩০ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে বনসংরক্ষকের দপ্তর থেকে প্রচারিত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভাওয়াল গড়ের শালবন ঐতিহাসিক ভাবে জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, আবাসন, জবরদখল ও ভূমি বিরোধের কারণে শাল বনের জীববৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে (সূত্র: পত্র নং- ২২.০১.০০০০.১০১.০০০.০২৩.) । করপোরেট দখল থেকে প্রাচীন এই শালবন বাঁচাতে সাফারি পার্ক এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলেও শুরু থেকেই স্থানীয় প্রাণপ্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় এই প্রকল্প গুরুত্ব দেয়নি। বাইরে থেকে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী না এনে শালবন বাস্তুতন্ত্রের প্রাণী ও উদ্ভিদের সুরক্ষা করেই রাথুরা শালবনকে এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। তাহলে আজকে প্রাণীমৃত্যু বা বাইরে থেকে আনা প্রাণীদের নিয়ে যে সংকটে পড়তে হচ্ছে তা হতো না। বরং পৃথিবীর এক প্রাচীন শালবনভূমি আবার নতুনভাবে দুনিয়ায় উদাহরণ তৈরি করতে পারতো।
৪.
আজ যেখানে সাফারি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, এটি পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা বন। ভাওয়াল শালবনকে একসময় বলা হতো ময়ূরবন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রবীণ বেলায়েত হোসেন ১৯৫৫ সালে বুড়িপাবরচালা থেকে ময়ূরের ডিম খুঁজে পেয়ে তা মুরগির তায়ে ফুটিয়ে সেই ময়ূর বড় করেছিলেন। তার মতে দেশ স্বাধীনের পর আর শালবনে ময়ূর দেখা যায়নি। ১৯৮৫ সালে ভাওয়াল বনে শেষ ময়ূর-দর্শনের কথা শোনা যায়। কালিয়াকৈরের মৌচাক ইউনিয়নে হরিণহাটি নাম একটি গ্রাম আছে। হরিণের জন্যই এমন নাম হয়েছিল এ গ্রামের। কিন্তু এখন এটি ইটপাথরের বিল্ডিং কারখানা বোঝাই এক দমবন্ধ শ্রমিকবস্তি। হরিণ ও ময়ূরের পাশাপাশি একসময় এই শালবন বাঘশূণ্যও হয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালে ভাওয়াল শালবনে বাঘের সর্বশেষ বিচরণের কাহিনি জানা যায়। বাঘের স্মৃতি নিয়ে এখনও ভাওয়াল শালবনে টিকে আছে বাঘের বাজার, বাঘেরচালা, বাঘেরবাইদ, বাঘাডোবা এলাকাগুলি। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে ফ্রাঙ্ক বি সিমসন শালবন থেকে উপকূল দেশের নানাপ্রান্তে শিকার করে বেরিয়েছেন। তার সেইসব নির্মম শিকারকাহিনি লন্ডন থেকে ১৮৮৬ সালে 'দ্য লেটার্স অন স্পোর্টস ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল' নামে প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ে বন্যপ্রাণী ভরপুর এক শালবনের স্মৃতি আছে। ভাওয়াল শালবনে ২২০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির উভয়চর ও ৫ প্রজাতির পাখি টিকে থাকার কথা জানা যায় । অন্য এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৪ প্রজাতির লতা, ২৭ তৃণ, ৩টি পাম, ১০৫ প্রজাতির গুল্ম, ১৯ প্রজাতির ছোট উদ্ভিদ ও ৪৩ প্রজাতির বৃক্ষসহ মোট ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ ভাওয়াল শালবনে রয়েছে (সূত্র : Our nature (২০০৫) ৩:৮৩-৯০)। নুহ আলম ও এম এ গফুর ২০০৮ সালে ভাওয়াল গড়ের চন্দ্রা শালবন থেকে মোট ১২ প্রজাতির লাইকেন শণাক্ত করেন (সূত্র : : Bangladesh J. Bot. ৩৭(১): ৬১-৬৫)। শাল, গাদিলা, কুম্ভি, আজুলি, আনই, বংকুই, কুল বড়ই, বনবড়ই, মনকাঁটা, বনবাঁশ, জয়না, বট, বিলাইপেঙ্গা, সোনালু, আমলকী, হরিতকী, বহেরা, গন্ধভাদাইল্যা, কুমারীডোগা, নেংগুরা লতা, ঝিনইলতা, আলেকলতা, গিলা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এই বনের মুমূর্ষু প্রাণ। এখনো আনইগোটা, বেকইগোটা, বুদবড়ই, পলাগোটা, বনখাজুর, তিতিজাম, গোটাজাম, মামালাড়–র মতো কিছু বুনো ফলের গাছ টিকে আছে এই শালবনে। তো এই শালবন বাস্তুতন্ত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃংখল কিংবা প্রতিবেশ-সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে কেবলমাত্র এখানকার বুনো প্রাণপ্রজাতিরাই। জেব্রা, জিরাফ, সিংহ বা ক্যাঙ্গারু নয়। তো সাম্প্রতিক এই প্রাণীমৃত্যুর পর সাফারি পার্ক বিষয়ে আমাদের স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র, বিচরণস্থল, খাদ্যশৃংখল এবং প্রতিবেশগত সম্পর্ককে গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি। বাইরে থেকে প্রাণীদের না এনে স্থানীয় প্রাণপ্রজাতির বিস্তার, বিকাশ ও সুরক্ষায় বহুমুখী পরিকল্পনা দরকার।
৫.
বাংলাদেশ বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক বনভূমিতে নানা ধরনের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যেমন, সংরক্ষিত বন, অভয়ারণ্য, গেম রিজার্ভ, প্রতিবেশগত সংটকাপন্ন এলাকা, সাফারি পার্ক, জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ২৪নং ধারায় উল্লেখিত আছে, সরকার বন্যপ্রাণী সম্পদ তাহার নিজ আবাসস্থলে (ইন-সিটু) বা আবাসস্থলের বাহিরে অন্যত্র (এক্স-সিটু) সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এবং জনসাধারণের গবেষণা, চিত্তবিনোদন এবং শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যে কোন সরকারি বনভূমিকে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সাফারি পার্ক, ইকোপার্ক, বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র বা উদ্ভিদ উদ্যান ঘোষণা করিতে পারিবেন। ১৯৯৯-২০০০ সালে কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার উপজেলাধীন ডুলাহাজরায় ২২৩৭.০ একর এলাকা নিয়ে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। গাজীপুরে ২০১০ সালে দ্বিতীয় 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক' গড়ে ওঠে। বিদ্যমান দুটি সাফারিপার্কের অবস্থা করুণ। এর ভেতরে আবারো মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের প্রাকৃতিক বন, বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণপ্রজাতির সুরক্ষা জোরদার ও নিরাপদ না করে একের পর এক সাফারি পার্ক গড়ে তোলা কতোটা জরুরি?
পাভেল পার্থ, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক, animistbangla@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments