সবজি চাষের বিপ্লব ও পুষ্টি স্বয়ংসম্পূর্ণতার বাংলাদেশ

আদিতমারী উপজেলার একটি খেত থেকে শাক তুলছেন এক নারী। ছবি: স্টার

অন্যান্য ফসলের তুলনায় বর্তমানে সবজি উৎপাদন কৃষকের জন্য অত্যন্ত সুখকর, কারণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় সবজিতে ফলন ও আয় দুইই বেশি। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সবজি উৎপাদন প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। যার ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, কৃষকের ও শ্রমিকের আয় বেড়েছে, নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে, ভূমিহীনদের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং কিছুটা হলেও কৃষকের অভাব অনেকটাই কমেছে।

আয়তনের দিক দিয়ে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে চীন ও ভারতের পরে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। অতীতেও যেমন সবজি উৎপাদনে আঞ্চলিক প্যাটার্ন ছিল, এখনো তা অক্ষুণ্ণ আছে। যশোর, কুমিল্লা, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় সবজি উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে, যা মাত্র ৪ দশক আগেও ছিল অভাবনীয়। এর ফলে শিক্ষিত যুব সমাজ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও ইনোভেটিভ ধ্যান-ধারণা নিয়ে সবজি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পাহাড় ও উপকূলীয় অঞ্চলে সবজি চাষ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বাড়ির আঙিনা, বাঁধ, ঘেরের পাড়ে এমনকি মাছ চাষের জলাশয়গুলোর ওপর চাউনি দিয়ে লতানো সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে এবং বসতভিটায় সবজি চাষের ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু হাওর অঞ্চলে সবজির ঘাটতি এখনো চোখে পড়ার মতো।

কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ বছর বাংলাদেশে ৯ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। উৎপাদন টার্গেট ২ কোটি ১৯ লাখ মেট্রিক টন। শীত, গ্রীষ্ম, সারাবছর চাষ হয় এবং কিছু বিদেশি জাত মিলে বাংলাদেশে প্রায় ১৪২ ধরনের সবজি চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি যে সব সবজি বাংলাদেশে চাষ হয়, তার মধ্যে টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল কুমড়া, পটল, ঝিঙা, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচা মরিচ, ধুন্দল, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, শসা, ক্ষীরা, মুলা, শিম, গাঁজর, পুইশাক, লালশাক, বরবটি, সজনে, শিম, ধনেপাতা, মটরশুঁটি ও কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি।

কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ এর সঙ্গে জড়িত। মোট সবজির ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন এবং বাজার মূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

শীতকাল বিভিন্ন শাকসবজি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এসময় নানা ধরনের শাক সবজির চাষ হয়। আর এর উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন সময়ে শাকসবজির চাষ করা একটু কষ্টসাধ্য। কারণ এসময় রোদ, বৃষ্টি, খরা, শিলাবৃষ্টিসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। সেজন্য একটু সতর্কতার সঙ্গে এসময় বিভিন্ন সবজির চাষ করতে হয়। এসময় গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, বরবটি, পটল, শসা, ঝিঙ্গা, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, গিমা কলমি, পুঁইশাক, মুখিকচু, মানকচু, মৌলভীকচু, পানিকচু, সজনে, মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়ার চাষ করা যায়।

গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ফাল্গুন-চৈত্র মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। তবে আগাম চাষ করতে পারলে বাজার মূল্য বেশি পাওয়া যায়। শাকসবজি চাষে প্রধান কাজটি হলো জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি, আলো-বাতাস চলাচলের সুবিধা, সেচের সুবিধা, অতি বৃষ্টির সময় জমি থেকে পানি বের করার সুবিধা আছে এরকম উর্বর দো-আঁশ মাটি সবজি চাষের জন্য অত্যন্ত ভালো। শাকসবজি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ফসল। সেজন্য একটু যত্নের সঙ্গে এর চাষ করতে হয়। সবজির জমি খুব মিহি ও ঝুরঝুরেভাবে তৈরি করতে হয়। জমি সমতলভাবে তৈরি করতে হয়। এজন্য প্রতিটা চাষের পরপরই ভালোভাবে মই দিলে জমিতে বড় কোনো ঢেলা থাকবে না। বেড় করে শাকসবজি চাষের ব্যবস্থা নিলে সেচ ও পরিচর্যার সুবিধা হয়, আর ফলনও বেশি হয়। জমি তৈরির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিয়ে 'জো' এলে তারপর চাষ-মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বুনতে হয়। আবার অনেক রকমের সবজি মাদাতে লাগাতে হয়, যেমন- শসা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়া। এগুলোর প্যাকেটে চারা তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাদা তৈরি করে চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে চাউনি বা মাচা তৈরি করে দিতে হয়। মাদাতে চারা লাগানোর আগে পরিমাণমতো সুষম হারে রাসায়নিক সারও দিতে হবে।

শাকসবজি চাষে সারের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পরিমাণমতো গোবর, টিএসপি, এমপি সার শেষ চাষের সময় ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়। ইউরিয়া সার চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম উপরি প্রয়োগ করতে হয়। দ্বিতীয় বার উপরি প্রয়োগ করতে হয় আরও ১৫ দিন পর। লাউ বা কুমড়া জাতীয় অন্যান্য সবজির বেলায় মাদা তৈরি করে প্রতি মাদায় গোবর ১৫ কেজি, সরিষার খৈল ৫০০ গ্রাম, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, টিএপি ২৫০ গ্রাম এবং এমপি ২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। শুধু জৈব সার ব্যবহার করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে জৈব সার সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। গোবর বা কমপোস্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শাকসবজি চাষে যে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো- বীজ বপন বা চারা রোপণ। আধুনিক জাতের ফসলের ভালো বীজ জমিতে উপযুক্ত 'জো' অবস্থায় বপন করতে হয়। বীজ বপন বা চারা রোপণের কাজ বিকেলে করা ভালো।

গাছের গোঁড়ায় আগাছা হলেই তা সঙ্গে সঙ্গে তুলে পরিষ্কার করে দিতে হবে। রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বীজ বপনের পরপরই পিঁপড়া বীজ নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য সেভিন পাউডার বীজতলার চারদিকে লাইন করে ছিটিয়ে দিতে হয়। ফল জাতীয় সবজি, যেমন: বেগুন, মিষ্টিকুমড়া এসব গাছে বা থোকায় অতিরিক্ত ফল থাকলে সেগুলো পুষ্টির অভাবে ঠিকমতো বাড়তে পারে না। এতে ফল আকারে ছোট, বিকৃত ও নিম্নমানের হয়। ফল ছোট থাকেই ফল পাতলাকরণের কাজ সম্পন্ন করলে গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বাড়ে।

ঢলে পড়া ও গোঁড়া পচা রোগ থেকে চারাকে রক্ষার জন্য আগেই মাটি শোধন করা ভালো। চারা গজানোর পর 'গোঁড়া পচা' রোগ দেখা দিলে বীজতলায় পানির পরিমাণ কমাতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশন করে অথবা শুকনো বালি বা ছাই ছিটিয়ে দিয়ে আর্দ্রতা অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। একইসঙ্গে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ করে রোগের বৃদ্ধি রোধ করা যায়।

লক্ষণীয় যে, এই গ্রীষ্মকালীন সবজিগুলোই এখন কৃষকের জন্য হয়েছে গলার কাঁটা। এই কাঁটা দূর করার জন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন: ইউনিয়ন পরিষদ ভিত্তিক গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্রয়ের স্থান নির্ধারণ করা, যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন সবজি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর রাখবে, স্কুল, কলেজ ও খেলার মাঠগুলোও আপদকালীন সময়ে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সবজি সরাসরি কিনে ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সরবরাহ করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও, স্থানীয় কৃষি অফিস, বিএডিসি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তররের সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারভিশনে উপজেলা অনুযায়ী একটি করে টিম গঠন করে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সবজি ক্রয় করে, বড় বড় শহরগুলোতে পাঠানোরে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বড় বড় সুপারশপগুলোকে সবজি উৎপাদনকৃত জেলায় গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সবজি কেনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। এখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহায়তা করতে পারে।

একমাত্র কৃষি খাতের সফলতার ওপর আমাদের ১৭ কোটি জনগণের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। আর এই খাতের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে দেশের প্রায় এক কোটি কৃষক পরিবারসহ ছোট-বড় অসংখ্য কৃষি উৎপাদক, যারা ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগানই শুধু দিয়ে যাচ্ছে না, বেশ কিছু রপ্তানিযোগ্য পণ্যেরও জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি উৎপাদকরা সামগ্রিকভাবে চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। কৃষি উৎপাদকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উৎপাদন করে, তা গ্রীষ্মকালীন সবজি, ধান, পাট, ডিম, দুধ, মুরগী যাই হোক না কেন, তার কোনোটিরই উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। অবশ্য ভোক্তা পর্যায়ে এ সবকিছুরই মূল্য যথেষ্ট বেশি। তার মানে টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এ ঘটনা অবশ্য সারা বছরই ঘটছে, তবে বর্তমান কোয়ারেন্টিনের মধ্যে সেই সংকট আরও গভীর হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও গভীরতর হতে চলেছে।

পাইকারি বাজারে পণ্য আছে কিন্তু ক্রেতা নেই, পণ্য পরিবহনে চলছে নানারকম বাঁধা-বিপত্তি। ফলে উৎপাদক কম দামে লোকসান দিয়ে তার পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ৪ টাকা পিস ডিম, ২৫ টাকা লিটার দুধ, ৪৫ টাকা কেজি ফার্মের মুরগী আর ৩ টাকা কেজি বেগুন, ২ টাকা কেজি টমেটো, ২ টাকা কেজি শসা, ৩ টাকা কেজি ঢেঁড়স তার কয়েকটি উদাহরণ। অথচ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। শিল্প উৎপাদকরা বাজারে চাহিদা কমে গেলে প্রয়োজনে যেকোনো সময় উৎপাদন কমিয়ে দিতে বা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু কৃষি উৎপাদকরা চাইলেই সেটা অনেক সময় করতে পারে না। ফলে লোকসান হয় অবধারিত। এরকম চলতে থাকলে দেশের কৃষক সমাজ ও কৃষি উৎপাদকরা তো মারা পড়বেই, উপরন্তু দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পসমূহ, যেমন: কৃষি উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ইত্যাদিও মহা সংকটে পড়বে। তাই দেশের কৃষক তথা সামগ্রিকভাবে কৃষিকে বাঁচাতে এখনই সরকারকে জরুরিভিত্তিতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতেই হবে। যেমন: কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে প্রণোদনা হিসাবে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, কৃষি ঋণ মাফ করা বা সুদ মওকুফ করা, বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে নতুন ঋণের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে ভারতের মতো মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ ঘোষণা করে তা সরকারি উদ্যোগে নিশ্চিত করা, কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ ও পরিবহণ বাধামুক্ত করা, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে চাহিদা নিরূপণ করে এলাকাভিত্তিক উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি।

ড. শামীম আহমেদ: অতিরিক্ত উপপরিচালক, (কন্দাল, সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল), হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments