সংস্কৃতির দুর্নীতি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি
হেডলাইনটি দেখে হয়তো অবাক হতে পারেন। কিন্তু সংস্কৃতির দুর্নীতির ভয়াবহতা হিসাব রাখা খুবই কষ্টকর। কারণ, এর কুফল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। কালচার বা সংস্কৃতির একটা ধারণা দিলে হেডলাইনের তাৎপর্য বুঝতে সহজ হবে।
ছোট করে যদি সংস্কৃতির সংজ্ঞা বলতে হয়, তাহলে বলা যায় একটা সমাজের জীবনধারণের জন্যে আমরা যা কিছু প্রকাশ করি, যোগাযোগ থেকে শুরু করে জীবন চর্চা; তা সবই সংস্কৃতির অংশ। এর পরিধি বিশাল এবং এর প্রভাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যাপক। ব্যাপক বলেই আমরা ভিনদেশে গিয়েও নববর্ষ পালন করি। সংস্কৃতির ভেতরে রয়েছে প্রথা, রীতি, নীতি, ভাষা, আচরণ, কলা, আইন, বিশ্বাস প্রভৃতি। একে বিশ্লেষণ করা সহজ নয় বলেই, উন্নত সমাজ কালচারাল মিনিস্ট্রি বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলে একটা রাষ্ট্রীয় বিভাগ খুলেছে আর আমরা সেখান শুধু বিষয়টা কপি করে এনেছি। কিন্তু কাজ ও চর্চার বেলায় লবডঙ্কা।
কেন লবডঙ্কা, তার উদাহরণ আমরা পাই যখন দেখি বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ সংস্কৃতির অর্থ মনে করে নাচ, গান, ছবি এবং চলচ্চিত্র তৈরি করাকে। এইটা গেল সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। আর যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেখি, তাহলে সরকারি চাকরির প্রথম পছন্দ হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তর্কের খাতিরে এই দুই মন্ত্রণালয়কে প্রথম এবং প্রধান ধরে নিলাম। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়গুলোর প্রধান কাজ আসলে কী?
উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, বিগত বছরের বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম ৫ জনের একজন আয়মান সাদিক সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানায় যে, সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করতে চায়। কারণ, দেশের সংস্কৃতি অন্যান্য দেশের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। যদিও তার অজান্তেই তার এই কাজ কঠিনসাধ্য হয়ে যাবে । সংস্কৃতির চর্চাই যদি না থাকে, তাহলে সে আসলে কি তুলে ধরবে? দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সংস্কৃতির চর্চা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে নিজ দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এইসব আবেগী কথা বলা সহজ হয়।
যাই হোক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানাবিধ সম্পর্ক স্থাপন। এখন এই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্যে প্রথম এবং প্রধান বিষয় হচ্ছে যোগাযোগ। আর এই যোগাযোগ মানে ভালো মতো ইংরেজিতে কথা বলা নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ হয় জাতীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। ব্যাপারটা আর একটু সহজ করে বললে বলতে হয়, বাংলাদেশি কেউ যদি শুধুমাত্র ইংরেজি বলে ব্রিটিশ কোন নাগরিকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তাহলে সেটা হবে হাস্যকর। কারণ কোনো ব্রিটিশ নাগরিক যেভাবে তার মাতৃভাষা ব্যবহার করবে, তার সঙ্গে বাংলাদেশি মানুষটি সেইভাবে কখনো পেরে উঠবে না।
আবার বিদেশি কেউ যদি কেবল বাংলা ভাষা বলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তখন প্রথম দিকে আগ্রহ থাকলেও সেটা সময়ের সঙ্গে পানসে হয়ে যাবে। বিদেশির বাংলা বলার দক্ষতা কখনোই আমাদের মতো হবে না। মূল বিষয় যেটা বলতে চাচ্ছি, ভাষা দিয়ে আসলে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেই। যেমনটা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; জাতিসংঘে বাংলাতে কথা বলে এবং তার নিজস্ব পোশাক পরে। ভারতে আমরা দেখতে পাই মহাত্মা গান্ধীকে। এই নেতারা কেউই কিন্তু এইসব সংস্কৃতির অংশ আবিষ্কার করেননি বরং তারা তাদের সংস্কৃতি নিয়ে সচেতন ছিল বলেই সেটা সময়ের সঙ্গে সঠিক জায়গায় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। আর এই জন্যই মুজিব কোট জাতীয়তার অংশ হয়ে গেছে। অথবা আমরা যখন কোনো দেশে সম্পর্ক স্থাপন করতে যাই, তখন উপহার হিসেবে ইলিশ মাছ অথবা দেশীয় পণ্য দিয়ে সম্পর্কের আয়োজন করি। তার মানে সংস্কৃতি যেমন যোগাযোগের মাধ্যম, সেই সঙ্গে সেটা আবার জাতির পরিচয়।
এখন যদি দেশের সংস্কৃতি চর্চা সেইভাবে না হয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসলে কী দিয়ে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে? অন্য দেশের ধার করা ভাষায় কথা বলে? সংস্কৃতির সচেতনতা নেই বলে আমাদের কথা শুধুমাত্র শ্রমিক নিয়ে হয়। কোন দেশের সঙ্গে কথা মানেই শ্রমিক পাঠানোর চিন্তা। দেখে মনে হয় পুরো দেশটা একটা শ্রমিকের কারখানা। সংস্কৃতি উন্নত না হলে চিন্তা উন্নত হয় না। তা আপনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
দুর্নীতি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা। যেমন- সংস্কৃতি মানে নাচ-গানের লোকজন। এর সঙ্গে যুক্ত আছে তথাকথিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাদের ব্যানার, পোশাক পরিচ্ছদও যে নিজ দেশের অথবা অন্য কোন দেশ থেকে ধার করা সংস্কৃতির অংশ সেটা তাদের মাথায় নেই। সুর করে কথা বলার সঙ্গে গানের সুরে যে মিল আছে, সেটা তাদের ধারণার বাইরে। এইটা তাদের দোষ নয়। বরং এটা হয়েছে আমাদের সংস্কৃতির দুর্নীতির জন্যে।
সংস্কৃতির দুর্নীতির কারণেই আমরা মূর্তি এবং ভাস্কর্যের পার্থক্য বুঝি না। বুঝি না পৃথিবীর যত বর্ণমালা আছে তার আদি উৎপত্তি চিত্রকলা থেকে। আদিম যুগে বর্ণমালা তৈরি হওয়ার আগে মানুষ ছবি এঁকে ভাব প্রকাশ করত, আর সেই ছবিই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণমালায় রূপ নিয়েছে। যেমন- মিসরীয় সভ্যতার হায়ারোগ্লিফ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুর্নীতি কীভাবে হয় এবং দুর্নীতি হলে কী হয়? দুর্নীতি হওয়ার প্রথম এবং প্রধান বিষয়টি হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ অথবা সেতু তৈরিতে আমাদের মিডিয়া এবং জনগণ যতটা না সজাগ, তার ৫ ভাগও সচেতন নই সংস্কৃতির দুর্নীতি নিয়ে। দেশের সব জেলাজুড়ে রয়েছে সংস্কৃতির বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও কার্যালয়। এই জায়গাগুলো হতে পারত লাইব্রেরি, দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র, তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার তীর্থস্থান। মাদরাসা অথবা স্কুল-কলেজ- কোনোটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বরং সব স্কুল-কলেজকে নিয়ম করে এইসব স্থানে আসার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে কারিকুলাম তৈরি করা যেত। ইরানি ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করা যেত, সিনেমা কেবল নাচানাচি অথবা গান ব-জনার বিষয় না, বরং জীবনকে বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য।
সিনেমা, গান অথবা নাচ এই সবই যোগাযোগের বিভিন্ন রূপ। বাংলা একটা চমৎকার ভাষা আবার এই বাংলা ভাষা দিয়েই আমরা গালাগালি করি। আরবি ভাষাতেও গালাগালি করা যায়, এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও। এর মানে এই না যে, এসব ভাষা খারাপ। ঠিক তেমনি সংস্কৃতি প্রকাশে বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এখন কেউ যদি সেগুলো এগুলো মার্জিত উপায়ে ব্যবহার না করেন, সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু নাচ, গান, সিনেমা অথবা চিত্র আঁকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পের সমস্যা নয়। শিল্প মানুষকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। আপনার ভাষার দক্ষতা কম থাকলে আপনি অনেক কিছুই লিখে বা বলে প্রকাশ করতে পারবেন না। ঠিক তেমনি শিল্পে অজ্ঞতা থাকলে আপনার প্রকাশ ভঙ্গিও সেইরকম হবে। এই জন্যেই আমরা শাহরুখ খান আর জায়েদ খানের অভিনয় দেখে শিল্পের পার্থক্য করতে পারি।
সংস্কৃতির দুর্নীতি হলে যেটা হয় সেটা হচ্ছে অন্য দেশের সংস্কৃতির আশ্রয় নিতে হয়। যেমন- এক সময় আমাদের তরুণরা আমাদের দেশের ব্যান্ডের ভক্ত ছিল। আমরা তাদের সেইভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে না পারায় এখন কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএস নতুনদের চিন্তায় বাসা বেঁধেছে। চারিদিকে পিৎজা আর বার্গার। কিন্তু আমাদের চাল দিয়ে তৈরি চাপটি কোনো অংশেই পিৎজা থেকে কম ছিল না অথবা চিতই পিঠা দিয়ে বিভিন্ন ঝোলের কারি। এ নকম শ'খানেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। জামা-কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নত দেশের তাদের সংস্কৃতি চর্চা আমাদের চিন্তা দখল করছে। আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের সন্তানরা বাংলা বলার আগে হিন্দি শিখছে অথবা ইংরেজি। নিজের অজান্তেই দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক সম্পর্কের কথা বাদই দিলাম। অর্থনীতির কথাও যদি চিন্তা করি, সেইটার মূল্যও কম নয়। নেটফ্লিক্সে যখন বিদেশি সিরিয়াল দেখেন, তখন সেই অর্থটা যায় সেই দেশের মানুষের কাছে।
অথবা যখন পিৎজা খাই তখন অর্থটা যায় বিদেশি কোন কোম্পানিতে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুসারে পুরো পৃথিবীতে পিৎজার বাজার ১২৮ বিলিয়ন ডলারের। অথচ আমাদের দেশের চাপটি হতে পারতো পিৎজার বিকল্প এবং এটি বানানোর ক্ষেত্রে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের পারদর্শিতা অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারত। ইতালির পিৎজা কিন্তু সাধারণ মানুষেরই খাবার ছিল। ইতালির শহরগুলোতে তাদের পিৎজা পাবেন। আমাদের তৈরি লাউ-চিংড়ি কিন্তু পাবেন না। কারণ, তারা তাদের সংস্কৃতির চর্চা করতে পেরেছে এবং চেষ্টা করছে।
শেষ কথা হচ্ছে, একটা সমাজে পরিচয়হীন হয়ে বেড়ে উঠা যেমন মানসিক কষ্টের; ঠিক তেমনি জাতি হিসাবে পরিচয় হারানোও কষ্টের। সংস্কৃতি কোন সম্পত্তি নয় যা একবার অর্জন করলে চিরদিন সেইভাবেই থাকবে। বরং সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হয়। তা না হলে, সংস্কৃতি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন অন্য সংস্কৃতিকে পুরোপুরি নকল করে কাক থেকে ময়ূর সাজতে হয়।
নুরুজ্জামান খান: চলচ্চিত্রকার, শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, হাঙ্গেরিয়ান ফাইন আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments