রাজনীতি ও ভাষার অপব্যবহার
বাকস্বাধীনতা এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয় ও গোপনীয়তা উভয়ই সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। একটা আর একটা মাড়িয়ে যেতে পারে না। আর সেই সীমাবদ্ধতাগুলোও সংবিধান ঠিক করে দিয়েছে। এই অধিকারগুলো একই সঙ্গে সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও এই অধিকারগুলো খর্ব করা যায় না। তাই, সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে, এই অধিকারগুলো টিকিয়ে রাখতে রাজনীতিবিদদেরই দায়িত্ব বেশি থাকে। আইনি দিক বাদ দিয়ে নীতিগত ভাবে দেখলেও রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব আগে চলে আসে। রাজনীতি যারা করেন, তারা শুধু দেশই চালান না, তারা জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। পারিবারিক শিক্ষা যেমনি মানুষকে পরিশীলিত করে, তেমনি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাও মানুষকে জাতীয় জীবনের আচরণ ও ব্যবহারকে তৈরি করে দেয়। এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষার খানিকটা আসে, রাজনীতিক আর রাষ্ট্রনায়কদের আচরণ আর ভাষার ব্যবহার থেকে। কারণ মানুষের মুখের ভাষা, শুধু যে কিছু প্রকাশ্য শব্দ তা নয়, বরং তা একজনের জীবনাদর্শ, নীতিজ্ঞান আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এরও প্রতিফলন।
বর্ণ বৈষম্যহীন আমেরিকার চরিত্র তৈরি হয়েছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের বক্তব্য আর ভাষার সুনিপুণ ব্যবহারে। তেমনি ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের চরিত্র তৈরি করেছিল জওহরলাল নেহেরুর মতো রাজনীতিকদের ভাষাজ্ঞান ও ব্যবহার। বাংলাদেশও যে সকল ধর্ম বর্ণ আর গোষ্ঠীর মানুষদের তার রূপরেখাও দিয়ে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মতো কিংবদন্তী রাজনীতিক। এই উদাহরণগুলো নির্দেশ করে, ভাষার ব্যবহার মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যেমনি বসায়, তেমনি রাষ্ট্র ও জাতি গঠনেও মারাত্মক ভূমিকা রাখে। ঠিক এর উল্টো উদাহরণও পৃথিবীতে আছে, যেখানে রাজনীতিকদের ভাষার ব্যবহার দেশ ও জাতিকে খণ্ডিত করেছে, ঘৃণার বীজ ছড়িয়েছে। যেমন: হিটলারের ইহুদি জনগোষ্ঠী আর অ-জার্মানদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্যমূলক বক্তব্য, ভারতের বিজেপির কিছু কট্টরপন্থী নেতাদের ধর্মীয় উস্কানিমূলক ভাষণ, ইসরায়েলিদের আধিপত্যবাদী ও শ্রেষ্ঠত্বের গরিমাময় বয়ান ইত্যাদি। ঠিক একইভাবে আমেরিকা মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে যতটা এগিয়ে ছিল, এক ট্রাম্পের আমলে তার উদ্ভট বর্ণবাদী কথার কারণে আমেরিকা ততখানি পিছিয়েছেও। সঙ্গে প্রতিপক্ষকে আক্রমণাত্মক ভাষার ব্যবহারের কারণে খুব বাজেভাবে হারতে হয়েছে ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। সার্বজনীনভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়, সেখানে ব্যক্তির প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক অবমাননাকর ভাষা কোনো স্বাভাবিক বা গঠনমূলক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে যেতে সাহায্য করে না।
তবে ভাষার জনজীবন-ঘনিষ্ঠ দর্শনের বা অভিব্যক্তির পাশাপাশি রয়েছে অন্যের কাজের আলোচনা ও সমালোচনা করার উপযোগিতা। একজনের কাজের অনাবেগী কঠোর সমালোচনাও এই ভাষার মাধ্যমেই করা যায়। কিন্তু সমালোচনা বা আলোচনার দোহাই দিয়ে যে যা-তা বলা যায় না, তা যেকোনো সাধারণ সভ্য মানুষেরই জানার কথা। বাংলাদেশ সংবিধানও এমনটাই বলে তার অনুচ্ছেদ ৩৯-এ। আর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিরা বা রাজনীতিকরা যে ভাষার ব্যবহারের যৌক্তিক সীমারেখা অন্যদের চেয়ে বেশি জানবেন ও মানবেন তেমনটাই কাম্য। সম্প্রতি, কতিপয় রাজনীতিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য খবরের শিরোনাম হয়েছে যার কারণে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোও বিব্রত। এগুলো একদিকে যেমন ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তেমনি দেশকে সংঘাতের ঝুঁকির মধ্যেও ফেলছে। এমন সব ঘৃণার উদ্রেক ঘটানো বক্তব্য, আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী 'হেট স্পিচ' (ঘৃণ্য বক্তব্য)। ডিজিটাল প্লাটফর্মে এমন ভাষার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে বা মানহানির কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বাংলাদেশ দণ্ডবিধির আলোকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আইনের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই সমান হতে দেখা যায় না।
রাষ্ট্রকে শুধু দালানকোঠা আর রাস্তাঘাট দিয়ে সাজিয়ে উন্নত করা যায় না। রাষ্ট্র সাবালক আর উন্নত হয় তার মানবিকতায়, উদারতায় আর ঐক্যে। আর রাষ্ট্র নেতাদের কাজই হলো রাষ্ট্রকে যত না উন্নত করা, তার চেয়ে বেশি আদর্শিক হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ রাষ্ট্র আদর্শ হলে, উন্নতি সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্যদিকে উন্নত রাষ্ট্র আদর্শহীন হলে, সে উন্নয়ন টেকে না। এমন আদর্শ-নির্ভর রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে সবার আগে দরকার, আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আর দরকার আদর্শিক মানুষ। কিন্তু রাজনীতির এই কলিযুগে, ব্যক্তিজীবনের মতোই রাষ্ট্রজীবনেও অনেক রাজনীতিবিদদেরই পরিমিত বোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। কোথায় কী বলতে হবে, এ সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞানের অভাব আমাদেরকে ভাবায়। দায়িত্ববানাদের দায়িত্বহীন ভাষার ব্যবহার ও আচরণ রাজনীতির অসুস্থ অবস্থাকেই সামনে তুলে ধরে। ইদানীং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বক্তব্যগুলো আর গোপন থাকে না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবারিত বাকস্বাধীনতার সুযোগে অন্যের প্রতি যেকোনো অসম্মানজনক বক্তব্য, যিনি বক্তব্য দিয়েছেন তার দিকে ফিরে আসে কয়েকগুণে। এমনটা নিশ্চয়ই বক্তব্যদাতার, তার পরিবার ও দলের জন্য আদৌ সম্মানজনক হয় না।
রাজনীতিকরা কোথায় কী বলবেন এ সম্পর্কে তাদের আগে থেকেই একটা হোমওয়ার্ক থাকা উচিত। তাদের জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা তাদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু ও সীমারেখা নির্ধারণ করবে, এমনটাই কাঙ্ক্ষিত। এক্ষেত্রে আত্ম নিয়ন্ত্রণবোধ থাকা জরুরি। একই সঙ্গে রাজনীতিকদের ভুঁইফোড় ইউটিউব চ্যানেলের ফাঁদে পড়া উচিত নয়। এরা উদ্দীপক খবর রটিয়ে ভিউ বাড়ানোর জন্য, উৎকট ও অবমাননাকর আলোচনার দিকে আলোচকদের ঠেলে দেয়। ক্ষমতার দাপটে অথবা পরিমিতি বোধের অভাবে অনেক রাজনীতিক তখন স্বেচ্ছাচারী কথা বলেন। অন্যের নামে কুৎসা রটাতে গিয়ে বা প্রতিপক্ষকে হেয় করার ইচ্ছা থেকে নিজের ও দলের অবস্থানের বারোটা বাজায়। এমন অপরিণামদর্শী রাজনীতিক কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই নিরাপদ নয়। অথচ একটা রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে বহু মানুষের ত্যাগ আর পরিশ্রমের বিনিময়ে। কিন্তু ঘৃণা ছড়িয়ে, আলোচনায় আসতে গিয়ে এই সমস্ত অযোগ্য রাজনীতিকরা দেশ ও জাতির যে ক্ষতি করছে, তা কোনো ভাবেই আমাদের দেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক দলের উচিত এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রমাণ করা দরকার, দলের চেয়ে বা দেশের চেয়ে কোন ব্যক্তি ক্ষমতাধর হতে পারে না; পারে না কেউ কথায় ও কাজের জুলুম করে জালিমের রূপ ধারণ করতে।
মো. রবিউল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Comments