মেয়াদোত্তীর্ণদের হক কথার এ কোন ধুম?

গত নির্বাচনে কোথাও কোথাও শতভাগের বেশি ভোট কাস্টিং দেখে লজ্জা লেগেছিল তখনকার সিইসি কে এম নুরুল হুদার। এতদিন পর এসে ওই লজ্জার কথা জানালেন তিনি। কেবল তাই নয়, বিএনপি না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না—এমন বোধের কথাও জানালেন নুরুল হুদা।

মনের কথা জানা কঠিন। তবে, দায়িত্বের ডেট এক্সপায়ারের পর বিশিষ্ট আরও কয়েকজনের মুখ বদল বেশ জমেছে গত কয়েকদিন। বদলে যাচ্ছে কথাবার্তার ধরন। বিশেষ করে সাবেক সিইসি, ভিসি, আইজিপিসহ কয়েকজনের উচিৎ কথা এমনি এমনি, নাকি এর পূর্বাপরে লুকিয়ে আছে অন্য কিছু? পদ-পদবিতে তারা মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও তাদের কথাবার্তাও ঘটনা। কেউ একবার সেলিব্রিটি হয়ে গেলে তার বা তাদের জৌলুস একেবারে তামাদি হয়ে যায় না। তাদের হাঁচি-কাশিরও মূল্য থাকে।

মেয়াদ শেষে বিদায়ের পর গত তিন-সাড়ে তিন মাস সিন আউট অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন বহুল আলোচিত-সমালোচিত সিইসি কে এম নুরুল হুদা। কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে এসে শোনালেন কিছু দামি কথা।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলতে বলতে বলেই ফেলেন, বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। 'আমরা দেখেছি কীভাবে মানুষ ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং জাল ভোট দেয়'—এমন স্বীকারোক্তিও দিলেন। দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় অভিমতের সঙ্গে কিছু সংসদ সদস্য প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ায় অস্বস্তিতে ভোগার কথাও জানান বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে অন্যরকম আসন গড়া এই সিইসি।

উচিৎ কথার দৌড়ে একটু দেরিতে এ কে এম শহীদুল হকও যোগ হয়েছেন আইজিপি পদ থেকে এক্সপায়ার হওয়ার বহুদিন পর। তারপরের জনের 'যাই-যাই' সময়ে এসে শহীদুল হক শোনালেন, 'সরকার চায় আজ্ঞাবহ পুলিশ'। এতো দিন পর মনে পড়লো বা বলা দরকার মনে করলেন কথাটি? কেন? তার ভাষায়, 'ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল চায়, তারা যা বলবে পুলিশ তাই করবে। সংসদ সদস্য চান, তিনি যা বলবেন, ওসি সেটাই করবেন। এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে কাজ করা খুবই কঠিন।'

নিজের অবস্থা জানান দিয়ে বলেছেন, 'আমি রাজনৈতিক অপশক্তির কাছে কখনো মাথা নত করিনি। আমি চেয়ার ধরে চাকরি করিনি। তবে আমার মতো তো সবাই পারবে না। এ জন্য একটা সিস্টেম বা পদ্ধতি চালু করা উচিত, যাতে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। আর রাজনীতিকরা তো চাইবেই না। রাজনৈতিক ও আমলাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে সুশাসনের কথাটি শুধু স্লোগানেই থাকবে। পুলিশকে অনেক বৈরি পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই পুলিশের সেবা চায়, কিন্তু কেউ পুলিশকে পছন্দ করে না। পুলিশকে ভয় পায় কিন্তু পুলিশকে ভালো জানে না।'

গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে নিজের লেখা বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে বলা সাবেক আইজিপি শহীদুলের বক্তব্যগুলো। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচক ছিলেন মেয়াদোত্তীর্ণ আরেক বিশিষ্ট জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, 'একটা কঠিন সময়ে' লেখক দায়িত্ব পালন করেছেন।

সরকারের সুবিধাভোগী তথা গুডবুকের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আরেফিন সিদ্দিকও উপলব্ধি করছেন যে 'এখন কঠিন সময়'? বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরে আসা আরেক সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহও কয়েকদিন ধরে 'ফুল ভলিউমে' বলে চলছেন দেশের কঠিন অবস্থার কথা। রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মাত করা আলোচিত ভিসি ড. মীজানও শোনাচ্ছেন অম্লমধুর কথা। অথচ ভিসি থাকা অবস্থায় 'ছাত্রলীগ করলেই চাকরি ফ্রি' ধরনের কতো আচানক কথাই না নিয়মিত শুনিয়েছেন সরকারের বিশেষ আস্থাভাজন এই ভিসি। তখন ভিসি, ইসি, ডিসি নিয়ে ট্রলের ধুমে রীতিমতো ঢোলের বাড়ি পড়েছিল।

মেয়াদোত্তীর্ণদের বাইরে মেয়াদে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত ভিসি প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামানও সম্প্রতি কয়েক লাইন উচিৎ কথা শুনিয়েছেন। 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কে কোন সংগঠন করবে, কোন সংগঠন করবে না—এটি একেবারেই তাদের নিজস্ব বিষয়। আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গভীরভাবে বিশ্বাস করি।'

এই ভিসি মেয়াদোত্তীর্ণ নন। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন হক কথায় থাকবেন তো মেয়াদের বাকি সময়টায়? উচিৎ কথার এ ধুমের মধ্যে সামিল হয়েছেন সরকার সমর্থিত পেশাজীবী নেতারাও। এক মতবিনিময় সভায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে সাক্ষী রেখে তারা অসাধারণ ধাঁচে বলেছেন, কেবল আমলারাই নয়, সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে তাদের অবদানও কম ছিল না। ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে বলে ফেলেন, ডিসিরাই সব কাজ করলে প্রকৌশলী, ডাক্তার, কৃষিবিদদের আর দরকার কী? আজকে ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ ডিসিদের দিয়ে করানো হচ্ছে। পদ্মা ব্রিজে রড কতটুকু লাগবে সেটা কি পদ্মা ব্রিজের পিডি শফিক জানবে? না মুন্সীগঞ্জের ডিসি বলবে?

আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা বলেন, 'এমন সকল লোকদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যারা মেডিকেলের একটা বইয়ের নামও উচ্চারণ করতে পারে না।'

মতবিনিময় সভাটিতে এ রকম আরও অনেক কথা এসেছে। সরকারের ঘোর সমর্থকদের এভাবে হক কথা-ক্ষোভ কথা বলা নিয়ে কিছু কথা বাজারে ঘুরছে। সামনে কোনো আলামত, নাকি নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর কৌশল হিসেবে তারা উচিৎ কথার পথ বেছে নিয়েছে?—এমনতর প্রশ্ন থাকলেও জবাব স্পষ্ট নয়।

টাটকা প্রশ্নটির আংশিক জবাব রয়েছে মধুসূদনের সেই বহু পুরনো, বহুল পঠিত কবিতার লাইনে, 'একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?' মন্থরা ছিলেন রাজা দশরথের স্ত্রী রাণী কৈকেয়ীর পিত্রালয় থেকে আগত কুব্জা দাসী। বিকৃতাকার, বক্রদেহা, ঈর্ষাপরায়ণা এবং কূটবুদ্ধি সম্পন্না এই নারী কুমন্ত্রণা দিতে নিপুণ হলেও ছিলেন কৈকেয়ীর প্রকৃত হিতৈষী। রামের বনবাসে মন্থরার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখায় হয়তো মন্থরার মুখ থেকে আশা করেননি, কিন্তু মন্থরা নিজেকে সংবরণ করতে না পেরেই বাক্যবাণে জর্জরিত করে অনেককে বলেছিলেন অনেক কথা। আর বঙ্কিমের কপাল কুণ্ডুলায় প্রশ্ন ছিল—পথিক তুমি কী পথ হারাইয়াছো?

বাংলাদেশের নমুনাও দুর্বোধ্য। কে নির্বাচনে এলো বা এলো না, কারো জন্য নির্বাচন থেমে থাকবে না, রাতে কোথাও ভোট হয়নি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়নি, জাল ভোট পড়েনি, পুলিশ সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কোথাও বেআইনি কিছু করেনি—হলফ করে এ ধরনের কথা বলা দায়িত্ববানদের এখন এমন বিপরীত কথা বিশ্বাস করা কারো জন্য কেবল কঠিনই নয়, অবিশ্বাস্যও। তারা কি এখন উপলব্ধিতে এসেছেন, স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, রাজসাক্ষী হচ্ছেন? নাকি ভুল স্বীকার করে অনুশোচনায় জ্বলছেন? নাকি ভিন্ন কোনো বুদ্ধিতে নামছেন? বঙ্কিম চন্দ্রের কপালকণ্ডুলার পথিকের মতো পথ হারিয়েছেন বা মাইকেল মধুসূদন মন্থরার মতো কথা ফাঁস করছেন? নাকি বিজ্ঞাপন চিত্রের মতো ফ্রুটিকা খেয়ে বেফাঁসে সত্য কথা বলা শুরু করেছেন? কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে, তারা জিজ্ঞাসার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্ঘাত। 'শেষ ভালো যার সব ভালো তার' শীর্ষক একটা মেঠো প্রবাদটিও এ ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাসঙ্গিক।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

8h ago