মুখে কেজরিওয়াল বগলে ইট!

দিল্লির পর আদমি পার্টি পাঞ্জাবের তখত জয় করায় কয়েকদিন ধরে আবারও কেজরিওয়াল ক্রাস। ভারতের রাজধানী দিল্লির সীমানা উতরে তা বাংলার রাজধানী ঢাকায়ও। অবচেতনেও অনেকে প্রকাশ করে ফেলছেন একজন অরবিন্দ কেজরিওয়াল পাওয়ার বাসনা। বলছেন, যদি পাওয়া যেত কেজরিওয়ালের মতো নেতা।

দিল্লি-পাঞ্জাব জয়ের পর আম আদমির নজর এখন গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের দিকে। সামনে ওই ২ রাজ্যের নির্বাচন। গুজরাট ভারতের রাজনীতিতে বিশাল ব্যাপার। একটি ট্রেন্ড বা ব্র্যান্ডের মতো। লাল কৃষ্ণ আদবানী, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা গুজরাটেরই প্রোডাক্ট। বিজেপির উত্থান গুজরাট থেকে। সেখানে একজন আম আদমির অভিলাস। কেজরিওয়াল আর পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ চষে বেড়াচ্ছেন, করছেন বিশাল বিশাল র‍্যালি। জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত সামিল হচ্ছে এসব র‍্যালিতে। দিল্লির আদমিরা চেয়েছে, পেয়েছে। পাঞ্জাবেও তাই।

কেজরিওয়াল মোটেই ঐশ্বরিক বা স্রষ্টার প্রেরিত মহামানব নন, দেবদূতও নন। মাটি ও মানুষের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক স্বচ্ছ চর্চা ও জনসম্পৃক্ততায় বেড়ে উঠেছেন দিনে দিনে। হরিয়ানায় জন্মানো এই কেজরি ছিলেন একজন প্রকৌশলী, আইসিএস অফিসার। চাকরির মোহ ছেড়ে তিনি কযেকজন রাজনীতিকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে নামলেও মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় আম আদমি পার্টি গঠন করেন। অল্প সময়ে অনেকের দৃষ্টিতে পড়েন। নানান কিছু করে ফেরার আওয়াজ দেননি। বিশেষ অঙ্গীকার করেন রাজস্ব আদায় ও সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি দমনের। ভারতের মতো ধনবাদী দেশে পরিবারতন্ত্র, হিন্দুত্ববাদ ও জাততন্ত্রের মধ্যে তার অভ্যুদয়।

নানা ঘটনা-রটনা, দুর্ঘটনার মধ্যেও প্রতিবেশি দেশটিতে এখনো কেজরিওয়াল জন্মানো এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ আছে। ভোটাধিকার আছে। এটাই যদি না থাকে তাহলে বাকি কোনো অধিকার আর থাকে? তারপরই না মানবের অধিকার, পানির অধিকার, বায়ুর অধিকার, পরিবেশের অধিকার, কেজরিওয়াল খোঁজার অধিকার। নানান দখল-দূষণে অভিশপ্ত পরিবেশে কেজরিওয়াল জন্মায়? 'মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট' শিরোনামের বাংলা প্রবাদটিতে এ প্রশ্নের জবাব আছে। প্রশ্নের পিঠেও প্রশ্ন আছে।

নিজে কি কেজরিওয়ালের ভোটার হওয়ার উপযুক্ত হচ্ছি আমরা? চাচ্ছি অন্তপ্রাণে? মন-মননে? গনতন্ত্রহীনতায় দম নিতে নিতে পারিবারিক শাসনে বশ্যতাতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে অনেকে। শাসনে-প্রশাসনে জবাবদিহিহীনতা, সুশাসনে খরা, সীমাহীন দুর্নীতি কারো কারো জন্য কল্যানের। বেশুমার অর্থ পাচার আশীর্বাদের। এরা সংখ্যায় কম, ক্ষমতায় আর হিম্মতে বলীয়ান। দেশের-সমাজের বহুজন ওই হিম্মতওয়ালাদের ক্যারিশমায় তুষ্ট। এমন অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের আদমিরা কিন্তু নিজেদের দাবি করেন সাধারণ নাগরিক।

খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ এই আদমিরা মাঠে-ঘাটে, টকশোতে পর্যন্ত বলেই বসছেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন উত্তম। কিসের মধ্যে কী? চোর-লুটেরাদের পক্ষাবলম্বন গোপন রাখতে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চান, উন্নয়নের কিছু প্রসব বেদনা থাকেই। চোরগুলো নিজেরা খায়, অন্যদেরও খাওয়ায়; দেশেরও উন্নয়ন করে। এ ধরনের চারিত্রিক উপসর্গধারীদের রাজ্যে কেজরিওয়াল পাওয়া এতো সোজা? খাটাস স্বর্ণকারের মতো বন্ধুকে ঠকায়, ছাড়ে না নিজের মাকেও, পারলে খোদাকেও ঠকানোর চরিত্র নিয়ে কেজরিওয়ালের আশা?

বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনায় শুনতে হয় দেশ স্বৈরাচারের দখলে, লুটেরার দখলে, পাচারকারীর দখলে, সিন্ডিকেটের দখলে ধরনের গালমন্দ। একেক সময় একেকটা ক্ষোভ, হাপিত্যেস। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলে গেছেন, 'বাজিকরদের হাতে দেশ'। তার পূর্বাপরে 'দেশ নষ্টদের দখলে যাবে' কাব্য লিখে গেছেন আরেক প্রয়াত বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। এরইমধ্যে দেশ নষ্টদের দখলে চলে গেছে কি না এ নিয়ে আর প্রশ্ন মানায় না। দখলের সঙ্গে দূষণের মাঝে হারিয়ে গেছে প্রশ্নটি।

দূষণ এখন প্রায় সবখানেই। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, পরিবেশ দূষণ, নদী দূষনসহ নানান দূষণে ননস্টপ শীর্ষ অবস্থান। এমন দূরাবস্থার কোনো লোকালয়ে কেজরিওয়াল জন্মায়? বা জন্মাতে দেওয়া হয়? অথবা জন্মালেও টিকবে? ভারতে জন্মেছে, টিকেছেও। যার নেপথ্যে আম আদমি বা আম জনতা বা সাধারণ জনগণের বিশাল অবদান। আবার দেশটির সরকারও কেজরিওয়ালকে বস্তাচাপা দেয়নি। অসীম না হোক, সীমিত হলেও আগে বাড়তে দিয়েছে।

রাজধানি দিল্লিতে নির্বাচনের আগে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির বেশ কিছু অঙ্গীকার ছিল। শুনতে নির্বাচনী বাকাওয়াজ মনে হলেও তার বেশ কিছুই বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। দিল্লির আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় আসার পর প্রতি পরিবারের জন্য ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রি দিচ্ছে। প্রতি পরিবারকে মাসে ফ্রি দিচ্ছে ২০ হাজার লিটার পানি। সরকারি স্কুলের অব্যস্থাপনা দূর করেছে। এখন ধনীরাও তাদের সন্তানদের প্রাইভেট স্কুল থেকে নিয়ে এসে সরকারি স্কুলে পড়াচ্ছে।

অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা অভিজ্ঞতা নিতে স্কুলগুলো দেখে অবাক হচ্ছেন। প্রতি মহল্লায় 'মহল্লা ক্লিনিক' নির্মাণ করে সর্ব সাধারনকে মান সম্পন্ন চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে চিকিৎসার সঙ্গে টেষ্টও ফ্রি। অতি দরিদ্রদের জন্য অপারেশন আর ওষুধও ফ্রি। দিল্লির রাস্তায় যে কারো গভীর রাতেও নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বিভাগ নগর কর্তৃপক্ষের অধীনে না থাকলেও কেবল সিসিটিভি বসিয়ে এই সমস্যার সমাধান করেছে। দিল্লির ব্যাধি নামে প্রচারিত যানজট প্রায় ৮০ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। ভাবা যায়?

কেজরিওয়ালের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তার সংস্থান করছেন কিভাবে? তার জবাব, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। অর্থাৎ জনসাধারণের জন্য সিরিয়াসলি কিছু করার ইচ্ছা। সরকারি কেনাকাটা আর রাজস্ব আহরনে দুর্নীতি দূর করে অর্থের সংকুলান করা হয়েছে।

আম আদমি পাঞ্জাবেও জিতে নতুন মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত নির্বাচনী ওয়াদা মতো ৩০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ফ্রি করে দিয়েছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েছে। দেশ চালাতে অর্থের দরকার আছে। সেই অর্থ কোনো না কোনোভাবে যোগাড়ও হয়ে যায়। তার আগে দরকার দিবালোকে প্রকৃত ভোট। ওই ভোটের প্রার্থীদের অঙ্গীকার। সেইসঙ্গে আদমি বা জনতার সচেতনতা, বোধ-বুদ্ধি। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটকে রাজাদের মামুলি কাজ ভেবে সেটার উচ্ছিষ্টে তৃপ্ত আদমিদের ভাগ্যে কেজরিওয়াল জোটে না। মুখে-মুখেই বলা যায় 'আমরাও কেজরিওয়াল চাই'। এরপরও বিবেকবান যারা, বাংলাদেশে আম আদমি পার্টির মতো পার্টি, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো নেতা খুঁজলেও দিল্লী-পাঞ্জাবের ওই ভোটারদের মতো ভোটার কি খোঁজেন? বরং মানুষকে সেই পথে যেতে দিতে ভয় অনেকের। বাংলার আদমিদের দলান্ধ করে রাখায় দীর্ঘমেয়াদি লাভ খোঁজার মহলও আছে। কেজরিওয়ালদের ভোট দেওয়ার মতো 'ভোটার' তৈরি হওয়ার পরিবেশটা তারা দেবেন কি না, তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়।

ধর্ম-কর্ম, জাত-পাত, গরু-গোবর, ভোট কাটা, বুথ দখল, সংখ্যালঘু তোষণের ওপরে ওঠে টানা তিনবার একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দিল্লির মসনদে বসা কেজরিওয়ালকে না চিনে তাকে খোঁজা অসুস্থতা। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতপ্রেমী বা ভারতবিদ্বেষী প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর কাছে কেজরিওয়াল জরুরি নয়। ভোটারদের কাছেও নয়। দল, ভোটার, সমাজ সবার কাছেই কেজরিওয়ালরা এখানে অচল-অপাঙ্কতেয়। মোটকথা অচল মাল। প্রায় সবাই বাড়ি ভাড়ার সময় ভালো মালিক-ভাড়াটিয়া চান। বিয়ের সময় ভালো মানুষ খোঁজেন। কিন্তু, নির্বাচনে প্রার্থীতা বা ভোটের সময় তার ছিটাফোটাও খোঁজেন?

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearance: Life term or death penalty for culprits

Government officials will face death penalty or minimum life sentence if found guilty of causing the death of enforced disappearance victims, according to a draft ordinance unveiled yesterday.

8h ago